জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনের পানি ও মাটিতে দূষণ বাড়ছে
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সুন্দরবনের পানি ও মাটিতে বেড়েছে লবণাক্ততা। নারা কারণে সুন্দরবনের পানি ও মাটিতে দূষণ বাড়ছে। বনসংলগ্ন এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপন, বনের মধ্য দিয়ে ভারী নৌযান চলাচল, বিষ দিয়ে মাছ শিকার এবং পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন ও পর্যটকদের উপস্থিতি বাড়ায় দূষণ হচ্ছে।
এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বনের গাছপালা, বন্য প্রাণী ও জলজ প্রাণীর ওপর। এ কারণে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই বনের পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমন এবং টেকসই পরিবেশ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সরকার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে।
পরে ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি সুন্দরবন প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার মৌজাগুলোর নাম সন্নিবেশ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু এ এলাকায় গত ১০ বছরে গড়ে শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। বেশ কয়েকটি শিল্পকারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পশুর নদে, যা বনের নদী ও মাটিতে মিশে যাচ্ছে।
শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপকুর, আঠুলিয়া, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ, রমজাননগর, ঈশ্বরীপুর এলাকার সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কাঁকড়া প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান, চিংড়ি পোনা উৎপাদন হ্যাচারি, চালকল, ওয়েন্ডিং কারখানা, ইটভাটা, পেট্রলপাম্প, হোটেল, মোটেলসহ বিভিন্ন ধরনের শতাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে মোংলা বন্দর থেকে বনের মধ্য দিয়ে কয়রার আংটিহারা এলাকা দিয়ে দেশি-বিদেশি জাহাজ চলাচল করছে। এসব জাহাজের ইঞ্জিনের শব্দ, হাইড্রোলিক হর্ন ও নৌযানের লাইটের আলোতে বন্য প্রাণীদের সমস্যা হচ্ছে।
নৌযান থেকে নিঃসৃত তেল ও বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে বনের মধ্যে। এতে দূষিত হচ্ছে বনের মাটি ও পানি। বেশ কিছু জাহাজ ও ট্যাংকারডুবির কারণেও দূষণ বেড়েছে।
আইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা যায়, গত ১০ বছরে ডুবে যাওয়া ৩৬টি জাহাজের মধ্যে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে পশুর, শেলা ও ভোলা নদীতে ডুবেছে ২১টি। এ ছাড়া ১৫টি ডুবেছে খুলনা-যশোরের বিভিন্ন নদীতে।
সম্প্রতি সুন্দরবন নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পশুর নদের প্রতি লিটার পানিতে তেলের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৮ মিলিগ্রাম। আর এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ মিলিগ্রামে। অথচ পশুর নদে তেলের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ১০ মিলিগ্রাম।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া নদ-নদীর পানি ও বনের মাটিতে দূষণ বেড়েছে।
সে কারণে অনেক স্থানে আগের মতো এখন গাছের চারা জন্মাচ্ছে না। এ ছাড়া নদের পানিতে তেলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জলজ প্রাণী। তিনি বলেন, যেসব রুটে নৌযান চলাচল করে, তার দুই পাশে বনের মধ্যে এখন আর তেমন হরিণ, বানরসহ অন্যান্য বন্য প্রাণী দেখা যায় না।
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. আ স ম হেলাল উদ্দিন আহম্মেদ সিদ্দিকী একাধিক গবেষণার বরাত দিয়ে জানান, বনের প্রায় ৪০ ভাগ সুন্দরীগাছের আগা মরা রোগ এবং ৫০ ভাগ পশুর হার্ট রট বা ঢোর রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
অধিক লবণাক্ত এলাকায় বয়স্ক সুন্দরীগাছ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। অধিক ও মৃদু লবণাক্ত—উভয় এলাকাতেই পশুরগাছ ঢোর রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ঢোর রোগে আক্রান্ত গাছের ভেতরের অংশ পচে যাচ্ছে।
বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে অন্তত ৪০ জন শিকারিকে হরিণের মাংস, চামড়াসহ আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে এক বছরে শুধু সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫১২ কেজি হরিণের মাংস, একটি জবাই করা হরিণ, পাঁচটি চামড়া ও মাথা উদ্ধার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, সুন্দরবন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের প্রাণ। ভারতের সুন্দরবনের ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ইসিএ এলাকা নির্ধারণ করে সেখানে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় না।
আর বাংলাদেশের সুন্দরবনের ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে ইসিএ। কিন্তু তা মানা হচ্ছে না। এটা মানতে হবে। তা নাহলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে।