ঘূর্ণিঝড় বুলবুলেও অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবন। ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিরূপণে আরো কমপক্ষে সাত দিন সময় লাগবে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, পশ্চিম সুন্দরবনে কমপক্ষে ১০ শতাংশ গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে প্রাণহানির সংখ্যা ২৩ জনে দাঁড়িয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে বিভিন্ন ঘটনায় মারা গিয়েছে ২৩ জন।সর্বশেষ গত সোমবার ভোলার মেঘনা নদীতে ট্রলারডুবিতে মারা যাওয়া ১০ জেলের ঘরে এখন শোকের মাতম। ওই ঘটনায় এখনো এক জেলে নিখোঁজ রয়েছে। এ ছাড়া সাতক্ষীরায় গাছচাপা পড়ে আহত আরেকজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। ভেঙে পড়া যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক বিশেষ সুবিধা পাবে জানিয়ে গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশের কৃষি খাতে মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৬৪ কোটি টাকা। ১৬টি জেলার মোট দুই লাখ ৮৯ হাজার ছয় হেক্টর জমির রোপা আমন ধান, শীতকালীন সবজি, সরিষা, মসুর, খেসারি ও পান বরজের ক্ষতি হয়েছে। ৫০ হাজার ৫০০ কৃষক কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের প্রয়োজন অনুসারে সাধ্যমতো সহায়তা দেওয়া হবে। কৃষিঋণ গ্রহীতাদেরও বিশেষ সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করা হবে।
এদিকে সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে সুন্দরবনে ক্ষয়ক্ষতির সার্বিক ধারণা পেতে কমপক্ষে সাত দিন সময় লাগবে। এ জন্য বন বিভাগের ৬৩টি ক্যাম্প কাজ করছে। প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী, পশ্চিম সুন্দরবনে ১০ শতাংশ গাছপালা নষ্ট হয়ে থাকতে পারে। তবে জলোচ্ছ্বাস না হওয়ায় বনের পশু-পাখি-জীবজন্তুর তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি বলে অনুমান করা যায়।
বন বিভাগের কর্মকর্তা এবং সুন্দরবন ও দুর্যোগ নিয়ে গবেষণা করেন—এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বুলবুল আছড়ে পড়ে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের একেবারে পশ্চিমে সাগর দ্বীপে। এখানেই মোহনা। বুলবুল এগোতে থাকে পূর্ব দিকে সুন্দরবন বরাবর। সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের গতিকে রুখে দেয়। বুলবুল আছড়ে পড়ার অন্তত তিন ঘণ্টা পর সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে। এ সময় ঝড়ের শক্তি অনেকটাই কমে গিয়েছিল। তবু সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের (সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জ) অনেক গাছপালা ভেঙে পড়েছে। বনের ওই এলাকায় গরানগাছের পরিমাণ বেশি। আবার গরানগাছ লম্বাটে ও চিকন হলেও বেশ শক্ত। এ কারণে ওই সব গাছের ক্ষতি কম হয়েছে। বেশি উপড়ে পড়েছে বাইন ও গেওয়া গাছ। আর যেহেতু জলোচ্ছ্বাস হয়নি, তাই ঝড়ে হরিণ বা অন্যান্য জীবজন্তুর কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম।
এদিকে, চলতি নভেম্বর মাসজুড়ে সুন্দরবনে সীমিত আকারে পর্যটন পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মাঝে ২৫ থেকে ২৭ নভেম্বর তিন দিন পর্যটন বন্ধ থাকবে। গতকাল সকাল ১১টায় খুলনার বন ভবনে ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের (টোয়াস) সঙ্গে বন বিভাগের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বশিরুল আল মামুন কালের কণ্ঠকে জানান, পানিতে কোনো সমস্যা নেই। তাই শুধু পর্যটক নয়, জেলেদেরও পাস-পারমিট দেওয়া হবে।
খুলনার বন সংরক্ষক মঈনুদ্দিন খান বলেন, ‘সুন্দরবনে আগামী ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত সীমিত আকারে পর্যটন চলবে। কারণ রাসমেলার আগে ট্যুর অপারেটররা পর্যটক বুকিং নিয়েছিলেন। সেগুলো ছাড়ার জন্যই নভেম্বর মাসে পর্যটন সীমিত করা হচ্ছে। আর ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার কারণে জেলেদের দুই দফায় মাছ শিকার বন্ধ ছিল। এ কারণে জেলেদের জন্য আজ (গতকাল মঙ্গলবার) থেকেই পাস-পারমিট দেওয়া শুরু হবে।’
জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তাণ্ডবের কারণে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে বিশ্রাম দিতে চায় বন বিভাগ। এ জন্য সুন্দরবনের ওপর থেকে চাপ কমাতে পর্যটকদের প্রবেশাধিকার সীমিত করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে আগামী ২৫ থেকে ২৭ নভেম্বর তিন দিন সুন্দরবনে সব ধরনের প্যাকজে ট্যুর বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
খুলনার বন সংরক্ষক মঈনুদ্দিন খান আরও বলেন, বুলবুলের আঘাতে সুন্দরবনের ক্ষতি নিরূপণে বন বিভাগ কাজ করছে। এরই মধ্যে অবকাঠামোগত ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মাহমুদুল হাসান জানান, বুলবুলের আঘাতে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের ছয়টি আবাসিক ভবন, ১৭টি অনাবাসিক ভবন, ১৯টি বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১০টি জেটি, তিনটি ট্রলার ও স্পিডবোট সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৈদ্যমারী এলাকায় বনায়ন করা ১৮০টি রেইনট্রিগাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে ৪৯ লাখ ৬০ হাজার টাকার ক্ষতির হিসাব মিলেছে। এর বাইরে বনের গাছপালার ক্ষতি নিরূপণে কাজ চলছে।
এদিকে সুন্দরবন থেকে চারটি ট্রলারসহ ৪৯ জন রাস উৎসবের দশনার্থীকে আটক করা হয়েছে। গত সোমবার সন্ধ্যায় বাগেরহাটের সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা উপজেলার আলোরকোল এলাকা থেকে বন বিভাগ তাদের আটক করে। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তারা অবৈধভাবে ট্রলার নিয়ে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় দুবলারচরে রাস উৎসবে যাচ্ছিল। তাদের সবার বাড়ি মোংলা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে।
জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে বিভিন্ন ঘটনায় মারা গিয়েছে ২৩ জন। চাঁদপুর থেকে মাছ বিক্রি করে ফেরার পথে মেঘনা নদীতে চরফ্যাশনের তোফায়েল মাঝির নৌকা ডুবে গিয়ে নিখোঁজ ১০ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। তারা সবাই চরফ্যাশনের দুলারহাট থানার বাসিন্দা। তারা হলেন খোরশেদ আলম, বিল্লাল, মফিজ, কামাল, কবির, নূরনবী, আব্বাস, হাসান, নজরুল ও রকিব। এ ছাড়া দুর্ঘটনার পরপরই ১৩ জেলেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
সাতক্ষীরায় ঘূর্ণিঝড়ের সময় স্থানীয় নিছার সরদার (৫৫) ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় ঘরের ওপর একটি গাছ ভেঙে পড়লে তিনি আহত হন। সোমবার রাতে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
এছাড়াও সাগরে নিখোঁজ ১৫ জেলের মধ্যে আটজন উদ্ধার হলেও গতকাল পর্যন্ত বাকি সাত জেলে ফেরেনি। তারা হলেন বরগুনা সদরের এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের লিটন, সুমন ও মোসলেম এবং তালতলী উপজেলার লালুপাড়া গ্রামের সবুজ, কামাল হাওলাদার, শানু হাওলাদার ও রাসেল হাওলাদার।
বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ‘এফবি তরিকুল’ সুন্দরবনসংলগ্ন নারিকেলবাড়িয়া এলাকায় মাছ ধরার সময় ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়লে এফবি গাজী নামের আরেক ট্রলারে এক জেলে ফিরে আসেন। ওই জেলে বুলবুল আঘাত হানার পরদিন অন্য একটি ট্রলার নিয়ে উদ্ধার করতে গিয়ে এফবি তরিকুলের খোঁজ পাননি। এর আরোহী ১৫ জেলের মধ্যে আটজনকে গতকাল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বালির চর থেকে উদ্ধার করা হয়।