গাছ কেটেই জলবায়ুর প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে !!
জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় যেখানে গাছ লাগানোকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে সরকার, সেখানে অবিশ্বাস্য হলেও গাছ কেটেই জলবায়ুর প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে উপজেলা মৎস্য অধিদফতরের বাস্তবায়নে এবং UNDP এর সহযোগিতায় উপকূলীয় বনায়ন ও পুনঃবনায়ন কমিউনিটি ভিত্তিক অভিযোজন শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে বাস্তবায়ন কমিটির উপর একটি গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
যেখানে বলা হচ্ছে – প্রকল্পের আওতায় পুকুর নির্মাণ করে তাতে মাছ, শাক-সবজি ও ফলসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা লাগানোর কথা থাকলেও তেমটি ঘটেনি উল্টো পুকুরগুলোতে মাছের পরিবর্তে কচুরিপানায় ভরপুর। নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার বনবিভাগের দুটি রেঞ্জ অফিসের আওতাধীন সরকারের উপকূলীয় সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এমনটাই পরিলক্ষিত হচ্ছে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়েছিল—জীবিকার বৈচিত্র্যায়নের মাধ্যমে জলবায়ুজনিত বিপদাপন্ন উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর দরিদ্রতা নিরসন, অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উপকূলীয় বনের ওপর নির্ভরতা কমানো হবে। প্রকল্পের আওতায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে পুকুর তৈরি করে সেখানে মাছ চাষ ও পুকুর পাড়ে শাক-সবজি চাষ করে এবং সেখানে ট্রেনিংয়ের ব্যাবস্থা করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করে তোলা হবে। যা জলবায়ুজনিত বিপদাপন্ন উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর দারিদ্রতা নিরসনের পাশাপাশি করবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে ব্যাবসায়ী হিসাবে গড়ে তোলা সক্ষম হবে।
এ ছাড়া স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে সহ-ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বনায়ন ও পুনঃবনায়নের মাধ্যমে প্রজাতির বৈচিত্র্য এনে জলবায়ু সহিষ্ণু জীবিকায়ন গড়ে তোলা হবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সাড়ে দশ হাজার পরিবারের ভিতরে ষাট হাজার জনকে জীবিকায়নের সহায়তা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে।
এই প্রকল্পের একটি বিশেষ মডেল হিসাবে বলা হয়েছিলো ‘বনজ-ফলদ-মৎস্য মডেল’ সংক্ষেপে “থ্রিএফ”। প্রতিটি মডেল বা পুকুরের দৈর্ঘ্যে ২৫২ ফিট এবং প্রস্থে ৪৯ ফিট। পুকুর হবে আট ফুট গভীর ও পাড়ের উচ্চতা হবে আট ফুট। মডেলটি ম্যানগ্রোভ বনের মাঝখানে পরিত্যক্ত বনভূমিতে নির্মাণ করার কথা।
জলবায়ু প্রকল্পের একটি পুকুর প্রকল্পে বলা হয়েছে, মডেলের আওতায় পুকুর খনন করে চারদিকে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে এই মডেল থেকে স্বল্প মাঝারি এবং দীর্ঘমেয়াদি পুনঃফসল বা সারা বছর ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিকে বিবেচনা করে অভিযোজন প্রক্রিয়া গ্রহণ করে তাদের জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন করা সম্ভব।
বনবিভাগের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির অধীনে প্রতিজন সুবিধাভোগীকে বিশ বছরের জন্য একটি পুকুর এবং তিনটি ডাইকের বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৮-২০১৯ আর্থিক সালে প্রকল্পটি আঠাশ হেক্টর পরিত্যক্ত বনভূমিতে প্রায় দেড়শো টি থ্রিএফ মডেল তৈরি করেছে। যার মধ্যে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় বিশ হেক্টর জমিতে একশত টি এবং ভোলার তজমুদ্দীন উপজেলায় বাকি আট হেক্টর জমিতে চল্লিশটি মডেল তৈরি করা হয়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে প্রতিটি মডেল ১টি ভূমিহীন দরিদ্র পরিবারের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়ায় তারা উপকৃত হচ্ছে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্যে আরও বলা হয়েছে, প্রতিটি মডেলে বিশটি বনজ ও বিশটি ফলদ জলবায়ু সহিষ্ণু গাছ লাগানো হবে। পাশাপাশি চল্লিশ টি পেঁপে গাছ লাগানোর মাধ্যমে স্বল্প ও মাঝারি সময়ের মধ্যে পনেরো-বিশ হাজার টাকায় পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার উৎপাদন সম্ভব হবে।
প্রকল্পের পুকুর গুলোর গভীরতা হওয়ার কথা ছিল কমপক্ষে দু মিটার।যার ভিতর প্রায় দুশো কেজি মাছ উৎপাদন সম্ভব হবে। তাছাড়া এই পুকুরকে কেন্দ্রকরে এর মিঠা পানি দিয়ে পুকুর পাড়, ডাইক ও মাচায় সবজি চাষ ও ফলজ গাছ করা হবে।
কিন্তু প্রকল্প এলাকা সরেজমিন ঘুরে এসবের কিছুরই দেখা মেলেনি। বরং সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মাঝ অংশেই গাছ কেটে পুকুর বানানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পুকুরগুলোতে মাছ তো নেই বিপরীতে সেগুলোতে জলজ লতাপাতায় ভরে ময়লা ও দুর্গন্ধ হয়ে আছে। পুকুর পাড়েও কোনও গাছপালা বা সবজির দেখা মেলেনি। কোনও কোনও পুকুরে কচুরিপানায় টইটম্বুর আবার কোনটার পানিও শুকিয়ে মাঠ হয়ে গেছে।
স্থানীয় সাগুরিয়া ৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা শামছুদ্দিন বলেন, আমার বাবা স্থানীয় একজন থেকে সত্তুর হাজার টাকা দিয়ে একটা পুকুর কেনেন। তিনি এই পুকুর বনবিভাগ ও ইউএনডিপি থেকে বরাদ্দ নেন। তখন বনবিভাগ আমাদের আশা দেখিয়ে বলেছিল, ফল ও কাঠের গাছ, মাছের খামার, সবজির বাগান ও বীজ দেবে। তবে এখন পর্যন্ত কিছুই পাইনি। আমারা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল জলিল বলেন, আমি একটি পুকুর পেয়েছি কিন্তু খনন করার জন্য আমাকে কোনও অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়নি এবং সম্পূর্ণ পুকুর নিজের টাকায় খনন করেছি। আমার বাবাও একটি পুকুর কিনেছেন। দুটি পুকুরে মোট এক লাখ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করে মাছ চাষ করেছি। পেয়েছি মাত্র ১৬ হাজার টাকা। বনবিভাগ ও ইউএনডিপি যে স্বপ্ন দেখিয়েছে তার কিছুই পাইনি। পুকুরের জায়গা বুঝিয়ে দেওয়ার পর কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি।
স্থানীয় জেলে আকবর হোসেন বলেন, পুকুরের মাঝে কেওড়া গাছের গোড়া দেখলেই তো বোঝা যায় এখানে গাছ ছিল যেগুলো কেটেই পুকুর করা হয়েছে। আমরা জানতাম পুকুরে মাছ থাকবে ও পাড়ে সাক-সবজি হবে কিন্ত এসবের কিছুই নেই।
বিষয়টির ব্যাপারে জানতে চাইলে সদ্য বিদায়ী সাগুরিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম বলেন, আমরা কোনও গাছ কেটে পুকুর নির্মাণ করছি না। জলবায়ুর প্রভাবের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের জন্য এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এ থেকে মানুষ উপকৃত হচ্ছে।
স্থানীয় বনবিভাগের জাহাজমারা রেঞ্জ কর্মকর্তা এসএম সাইফুর রহমান বলেন, থ্রিএফ মডেল প্রকল্প সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রকল্পটি তিনটি দফতর মিলে বাস্তবায়ন করছে। বনবিভাগ পুকুর খননের পর সেখানে গাছ লাগাবে। মৎস্য বিভাগ মাছ চাষ করবে আর কৃষি বিভাগ সবজিসহ অন্যান্য ফসল ফলানোর কাজ করবে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্য বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (নোয়াখালী) বিপুল কৃষ্ণ দাসকে প্রশ্ন পাঠালে তিনি কোনও উত্তর দেননি। তবে প্রকল্প উপদেষ্টা ও হাতিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মাহবুব মোরশেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে কিছু অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। সেগুলো খতিয়ে দেখছি।
প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা ইউএনডিপি বাংলাদেশের আইসিবিএ-এআর প্রোগ্রামের কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েট মিজানুর রহমান বলেন, এটি একটি ভালো ও সফল প্রকল্প। প্রকল্পটি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন এবং উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকার স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৩ সালে আর্থ কেয়ার অ্যাওয়ার্ড ও ২০১৪ সালে পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন সেলের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার জাকির হোসেন খান বলেন, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯টি উপকূলীয় জেলার প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ জলবায়ু ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে এসব এলাকার ১০ থেকে ১৫ ভাগ ভূমি তলিয়ে যেতে পারে। জেলাগুলোর প্রায় আড়াই কোটি জলবায়ু শরণার্থী হতে পারে। এই আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচতে যেখানে গাছ লাগানোর প্রয়োজন সেখানে গাছ লাগানোর টাকায় গাছ কেটে যদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় সেটি দুঃখজনক।
পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, আগামী বৈঠকে সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে প্রকল্পটির বিস্তারিত জানতে চাইবো। প্রয়োজনে ওই এলাকায় কমিটি বৈঠক করা যায় কিনা সে বিষয়ে উদ্যোগ নেবো।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, অনেক সময় প্রকল্পগুলো সচিবালয়ে বসেই করা হয়। ফলে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে যাওয়া হলে আর মিল পাওয়ার যায় না। এই প্রকল্পেও এমনটা হতে পারে। তারা হয়তো ভেবেছিল অনেক খালি জায়গা আছে। সেখানে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু গিয়ে দেখেছে সেখানে ভরা বাগান। গাছ কেটে জলবায়ুর প্রকল্প বাস্তবায়ন কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বাংলা ট্রিবিউন