ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়নে হুমকির মুখে বিশ্ব
হিমবাহের দ্রুত গলন, আর্কটিক অঞ্চলে নতুন বরফমুক্ত এলাকার উদ্ভব, রেকর্ড পরিমাণ খরার পর পরই রেকর্ড বৃষ্টিপাত-বন্যা, একের পর এক সাইক্লোন, তীব্র তাপপ্রবাহ যেন বিশ্বের জন্য নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০২৩ সালে রেকর্ড পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন ও দহন আবহাওয়ার অদ্ভুত এ আচরণ আরো উসকে দিচ্ছে। ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়নে আধুনিক মানবসভ্যতার ভিত্তি আরো হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন গবেষকরা।
৩০ আগস্ট শুক্রবার আমেরিকান মেটিওরোলজিক্যাল সোসাইটি (এএমএস) তাদের বার্ষিক বৈশ্বিক জলবায়ু সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। এ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের এক ভয়াবহ চিত্র। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব এখন দ্রুত এমন এক অবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যা মানবজাতির ইতিহাসে কখনো দেখা যায়নি।
এতে বলা হয়, ২০২৩ সাল ছিল ইতিহাসে রেকর্ড করা উষ্ণতম বছর। জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসেই বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
একই সঙ্গে বছরের জন্য গড় সমুদ্রের তাপমাত্রাও রেকর্ড পরিমাণ ১৮ দশমিক ৯৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল। এ কারণে নতুন নতুন দুর্যোগের দেখা দিচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে ঘূর্ণিঝড় থেকে শুরু করে আকস্মিক বন্যা ও খরা।
উত্তর আটলান্টিকে টানা সপ্তম বছরের মতো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুম দেখা গেছে। প্রশান্ত মহাসাগরে ধ্বংসাত্মক ঝড়ের একটি নতুন স্তর দেখা দিয়েছে।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় ফ্রেডি ছিল সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়, যা ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত পাঁচ সপ্তাহ স্থায়ী ছিল। অদ্ভুতভাবে এ সময়ে ঝড়টি সমগ্র ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে এবং মোজাম্বিক ও মাদাগাস্কারে তিনটি পৃথক স্থলভাগে আঘাত হানে।
হারিকেন ওটিস মাত্র ৯ ঘণ্টার মধ্যে ক্যাটাগরি ১ থেকে ক্যাটাগরি ৫-এ পরিণত হয়, যা একটি রেকর্ড।
এ ধরনের ঘটনাগুলোকে টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু বিজ্ঞানী ক্যাথারিন হায়হো ‘বৈশ্বিক উদ্ভটতা’ বলে অভিহিত করেছেন। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে অপ্রত্যাশিত বা চরম আবহাওয়ার উত্থান ঘটে।
গত বছর বিশ্বে রেকর্ড সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে একদিনের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল গড়ের চেয়ে বেশি। উদাহরণস্বরূপ আগস্ট ২০২৩-এ বেইজিংয়ে দুদিনেরও কম সময়ের মধ্যে রেকর্ড ৩০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছিল, যার ফলে ১৩৭ জন মারা যায়।
গ্রিসে একদিনে রেকর্ড ৩০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছে। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দাবানলও দেখা গেছে দেশটিতে। উত্তর ইতালিতে একটি সুপারসেল ঝড় হয়েছে, যাতে সাত ইঞ্চিরও বেশি ব্যাসের শিলাবৃষ্টি হয়েছে, যা ইউরোপীয় শিলাবৃষ্টির রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। জাপানের চেরি ফুল ১২৫ বছরের রেকর্ডে সবচেয়ে আগে ফুটেছে।
গবেষকরা বলছেন, আবহাওয়ার এমন বিরূপ আচরণ মানবসৃষ্ট। গত বছর এএমএসের গবেষণায় দেখা গেছে, বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব ৪২০ পার্টস পার মিলিয়নে পৌঁছেছে, যা প্রাক-শিল্প যুগের স্তরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি।
কার্বন ডাই-অক্সাইড ও উষ্ণতা বৃদ্ধির এই হার ক্রমান্বয়ে ত্বরান্বিত হচ্ছে। ২০২২-২৩ সালের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধির মাত্রা বিগত দশকের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি ছিল। যা ১৯৬০-এর দশকের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি।
২০২৩ সালে অক্সফোর্ড ওপেন ক্লাইমেট চেঞ্জে তিনি যে গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেছিলেন তাতে যুক্তি দেখিয়েছেন, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা প্রতি দশকে এক-তৃতীয়াংশ ডিগ্রি ফারেনহাইট থেকে প্রায় অর্ধ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত বাড়ছে।
হ্যানসেনের দল অনুমান করছে, বর্তমান জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট উষ্ণতার সঙ্গে এ হার যোগ করলে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির আদর্শ উষ্ণতাসীমা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি ফারেনহাইটে পৌঁছবে।
যে পর্যায়ে পৌঁছলে বিজ্ঞানীরা জলবায়ু উষ্ণতার সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব দেখা দেয়ার আশঙ্কা করেন, এ দশকের শেষ নাগাদই সে সীমা ছাড়িয়ে যাবে।
তারা আরো অনুমান করেন, ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৩.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) রেড লাইন অতিক্রম করবে। ফলে সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, আরো শক্তিশালী ঝড়, ব্যাপক খরা, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতসহ অপরিচিত ও অদ্ভুত আবহাওয়ার সম্মুখীন হবে পৃথিবী।