কুমিল্লা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ (ইপিজেড) এলাকায় সাড়ে চার বছর আগে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করে কেন্দ্রীয় তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন করা হয়। তখন মানুষ ভেবেছিল, তাদের জমিতে তরল বর্জ্য আর ঢুকবে না। নদী–নালা ও খাল–বিলের মাছ এবং জলজ উদ্ভিদ রক্ষা পাবে। কিন্তু তারপরও তরল বর্জ্য চুইয়ে পানিতে মিশছে। এ কারণে জলাশয়ের মাছ মরে যাচ্ছে। জমিতে ফসলের উৎপাদন কম হচ্ছে।
কুমিল্লা ইপিজেড প্রকল্পটি ২৬৭ দশমিক ৪৬ একর জায়গা নিয়ে অনুমোদিত হয় ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে । ২০০০ সালের ১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইপিজেডের উদ্বোধন করেন। বর্তমানে এই ইপিজেডে ১৯টি বিদেশি, ১০টি দেশি ও দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানাধীন ৩৭টি কারখানা চালু রয়েছে।
কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর কুমিল্লা ইপিজেডে কোনো ধরনের তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন করা হয়নি। এ নিয়ে ইপিজেড এলাকার আশপাশের বাসিন্দারা দীর্ঘদিন আন্দোলন করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইপিজেডের দক্ষিণ প্রান্তে বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন করার কাজ শুরু হয়। ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর ওই কাজ শেষ হয়। মেসার্স সিগমা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ওই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করে। বর্জ্য পরিশোধনাগারটি রাসায়নিক ও জৈবিক উভয় পদ্ধতিতে প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য পরিশোধন করতে পারে। ২৪ ঘণ্টা এটি চালু রয়েছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৭ অনুযায়ী, এর তরল বর্জ্য নির্গমণ মানমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। কুমিল্লা ইপিজেডের কারখানাগুলো কেন্দ্রীয়ভাবেই বর্জ্য পরিশোধনের সুযোগ পাচ্ছে। এরপরও তরল বর্জ্য দক্ষিণ কুমিল্লার বিভিন্ন ফসলি জমি, নদী–নালা, পুকুর, বিল ও জলাশয়ে চুইয়ে যাচ্ছে। এ কারণে ফসল কম হচ্ছে। নানা প্রজাতির দেশি মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
গত বুধবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার চৌয়ারা ইউনিয়নের টঙ্গীরপাড় এলাকায় ডাকাতিয়া নদীর স্লুইসগেটের নিচে পানির রং কালো। পানি থেকে পচা গন্ধ আসছে। এর লাগোয়া খাল ও বিলের পানিও কালো।
একই উপজেলার বিজয়পুর জেলখানা বাড়ি এলাকার রেলসেতুর নিচেও কালো পানি। কুমিল্লা-চাঁদপুর সড়কের বিজয়পুর পাকা সেতুর নিচেও কালো পানি। বামিশা, দিঘিরপাড় কলেজের আশপাশের কৃষিজমিতেও কালো পানি দেখা গেছে। লালমাই উপজেলার দত্তপুর এলাকার খালেও একই অবস্থা। লাকসামের ডাকাতিয়া নদীর অংশেও একই অবস্থা। কুমিল্লা সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজের পেছনের জলাশয় ও বিলের পানি কালো।রাজাপাড়া, নেউরা ও দিশাবন্দ এলাকার অন্তত ১২ জন কৃষক বলেন, আগে জমিতে ভালো ফসল পেতেন। এখন আর আগের মতো ফসল হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি মোসলেহ উদ্দিন বলেন, ইপিজেডের কারখানার বর্জ্যের কারণে আশপাশের শত শত ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে নানা প্রজাতির মাছ। তরল বর্জ্যের ফসল, মাছ ও শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এতে জটিল রোগ দেখা দিতে পারে।
কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘১০ বছর ধরে ইপিজেডের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিল্লাচিল্লি করছি। জেলা ও উপজেলা উন্নয়ন সভা ও আইনশৃঙ্খলা সভায় বক্তব্য দিয়েছি। কোনো কাজ হচ্ছে না।’
গতকাল শুক্রবার বিকেলে কুমিল্লা ইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক মো. জিল্লুর রহমানের কাছে ফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কুমিল্লা ইপিজেডের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার প্রতিনিয়ত লোক এসে পরিদর্শন করছেন। আমরা নিজেদের বর্জ্য নিজেরা নিয়ন্ত্রণে রাখি। আমাদের এখান থেকে বর্জ্য যাচ্ছে না।’