এতকিছুর পরেও ঠিক হচ্ছে না দেশের পরিবেশ
দেশের আবহাওয়া অফিসের পরিসংখ্যান বলছে, তীব্র তাপপ্রবাহ ভেঙেছে বিগত ৭৫ বছরের রেকর্ড। প্রতিদিন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে তাপমাত্রা থাকায় বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে জনজীবন। এর মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে গাছ লাগানোর কথা উঠে এলেও আসছে না সুষ্ঠু কোনো পরিকল্পনার রূপরেখা।
দেশের সচেতন নাগরিকরা যখন গাছ লাগানোর পক্ষে ক্যাম্পেইন করছেন, ঠিক তখন দেশের নানা জেলায় কেটে ফেলা হচ্ছে হাজার হাজার গাছ। ব্যক্তিপর্যায় বা কোনো দস্যুদের কাজ না, স্বয়ং বন বিভাগ মেতেছে এই ধ্বংসযজ্ঞে।
ঠাকুরগাঁওয়ের কথাই ধরা যাক। রীতিমতো দরপত্র আহ্বান করে সেখানে এরইমধ্যে ৫ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। খোদ বন বিভাগ বলছে, আয়তনের তুলনায় জেলাটিতে ২৫ ভাগ বনভূমি থাকার কথা, কিন্তু আছে মাত্র ২ ভাগ। একের পর এক খোঁড়া যুক্তিতে এসব জেলায় দেদার চলছে গাছ কাটার মহোৎসব।
শুধু ঠাকুরগাঁও নয়, একই অবস্থা কুষ্টিয়ায়ও। সেখানে বন বিভাগ ৩ হাজার গাছ কাটার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। চট্টগ্রামের রাউজানে শুধু রাস্তা বানানোর দোহাই দিয়ে অর্ধশতাধিক গাছ কাটা হয়েছে। শুধু এক সপ্তাহেই দেশের নানা জেলায় এভাবে বিপুল অংশের গাছ কাটা হয়েছে, যেখানে গাছ লাগানোর প্রসঙ্গে মুখে ফেনা তুলেও আসছে না কোনো প্রতিফল।
চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী জানান, দেশে বর্তমানে ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ বনভূমি আছে। যেখানে দেশে বনভূমি থাকার কথা ২৫ শতাংশ, তার তুলনায় এ পরিমাণ একেবারেই অপ্রতুল।
এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে রাজধানী শহর ঢাকা। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ সালে ঢাকা শহরে মোট বনভূমির পরিমাণ ছিল প্রায় ৭ শতাংশ, যা এখন কমে ২ শতাংশে নেমে এসেছে। দিন শেষে যতই পার্ক বা গাছ লাগানোর বক্তব্য বা জাঁকজমক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করা হোক না কেন, আদতে বাড়ছে না ঢাকার বনভূমি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, আইল্যান্ডে গাছ লাগিয়ে বা ছাদে বাগান করে কেউ যদি মনে করে ঢাকা শহরে বনায়ন সম্ভব হবে, তাহলে সেটা একেবারেই ভুল ভাবনা।
একটি ভবনের ছাদে যে পরিমাণ গাছ থাকে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়ে সেই ভবন থেকে। রাস্তার দুই পাশ দিয়ে হাজার হাজার গাড়ি যেভাবে পরিবেশ ধ্বংস করছে সেখানে আইল্যান্ডের গাছ একরকমের অসহায়।
রাজধানী ঢাকা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনার অভাব আছে উল্লেখ করে এ পরিবেশবিজ্ঞানী বলেন, সবাই জানে কী করতে হবে। সমস্যা হচ্ছে কেউ পদক্ষেপ নিতে চায় না। ২০ বছর আগেও ঢাকার অবস্থা এতটা নাজুক ছিল না যা বিগত কয়েক বছরে হয়েছে। ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের আওতায় না আনলে কোনোভাবেই পরিবেশ ঠিক করা যাবে না।
সিরাজ বলেন, গাছ লাগানোর জন্য খোলা জায়গার প্রয়োজন। সেই জায়গা নেই, নেই পর্যাপ্ত জলাভূমি। যেসব জায়গা দখল হয়ে গেছে, জলাভূমি ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো পুনরুদ্ধার করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ঢাকার যান্ত্রিকতা ও চাপ কমিয়ে শহরকে বাসযোগ্য না করলে ভবিষ্যতে আরও বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।
বাংলাদেশের তাপমাত্রা পরিমাপ নিয়ে আইনুন নিশাত বলেন, দেশের আবহাওয়া অফিস বলছে ঢাকায় তাপমাত্রা ৩৬-৩৮ এবং যশোরে ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলের তাপমাত্রা পরিমাপক সংস্থাগুলোর মতে দেশের তাপমাত্রা ঢাকাতেই ৪০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
দেশের অন্যান্য জায়গার মতো পরিবেশের বড় বিপর্যয় ঘটছে পাহাড়ি এলাকাগুলোতে। বিগত কয়েক দশকে চট্টগ্রাম বিভাগের পার্বত্য এলাকার পাহাড় কেটে জমি দখলের মতো ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, মহানগরের মধ্যেই ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের সংখ্যা প্রায় ৩০টি। মূলত যারা পাহাড় কাটেন এবং এ ধরনের অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের রয়েছে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের কাছে অনেক সময় প্রশাসন পর্যন্ত অসহায়।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, চট্টগ্রামে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় অনেক জায়গায় শুধু এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে যাওয়া পর্যন্ত যায়নি। পরিবেশ অধিদফতর একা এই দস্যুদের মোকাবিলা করতে পারবে না। এর জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক পদক্ষেপ।
পাহাড়ের ভূমিদস্যুদের রুখতে হলে পাহাড়কে ব্যক্তিমালিকানা থেকে সরকারের উচিত জাতীয় সম্পদে ঘোষণা করা। যেভাবে পাহাড় কাটা হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে চট্টগ্রামের বন্যা ও পাহাড়ধস পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে বলা মনে করেন সাবেক এ সরকারি কর্মকর্তা।
সব মিলিয়ে দেশে যে জলবায়ু পরিস্থিতি তার জন্য বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণকে প্রধান দায় দেয়া ভুল হবে না। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিজেদের রক্ষা করতে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে অনেক সময় সেগুলো হচ্ছে ভুল পদক্ষেপ না হলে একেবারেই অপ্রতুল।