ইতিহাসের মহামারীগুলো- তখনও মহামারীর বিস্তার রোধে মাস্ক, জনবিছিন্নতার নিয়মের প্রচলন ছিল
ডিসেম্বর ২০১৯ এ চীনের উহান শহরে প্রথম একটি নতুন করোনা ভাইরাস সনাক্ত হয়। ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস ভাইরাসটিকে মহামারী হিসাবে ঘোষণা করে।
এ নতুন কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসটির দাপ্তরিক নাম করণ করা হয় Novel Coronavirus COVID-19 । COVID এর পূর্ণরূপ Coronavirus Disease এবং এর কারিগরিক নাম Severe Acute Respiratory Syndrome Coronavirus 2, সংক্ষেপে SARS-CoV-2। অন্য ২ টি করোনাভাইরাস হল সার্স (SARS-CoV or SARS-CoV-1) এবং মার্স (Middle East respiratory syndrome – MERS, also known as camel flu ,সংক্ষেপে (MERS-CoV)।
WORLDOMETER এর তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস এর আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা জনহপকিন্সর বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইভ চার্টে নিম্নে পরিবেশিত হলো:- ।
নতুন করোনভাইরাস কোভিধ- ১৯ প্রতিরোধে এ পর্যন্ত ১০ টি ভ্যাকসিন আবিস্কৃত হয়েছে এবং এগুলোর প্রয়োগও সারা বিশ্বে শুরু হয়েছে। ভাইরাসটির বিরুদ্ধে সর্বাধিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুলোর মধ্যে কয়েকটি হ’ল সাবান এবং জল দিয়ে ঘন ঘন এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হাত ধোয়া, পরস্পরের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বঝায় রাখা এবং স্ব-বিচ্ছিন্নতা (quarantine)।
সংক্রামক রোগগুলির জন্য পৃথকীকরণের (quarantine) অনুশীলনটি ফরাসি বহু বিদ্যার অধিকারী ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) রচিত ১০২৫ সালে প্রকাশিত ক্যানন অব মেডিসিন (Canon of Medicine) এ উল্লেখ করা হয়েছিল, এটি পশ্চিমে অ্যাভিসেনা (Avicenna) নামে বেশি পরিচিত।
কোয়ারানটাইন (quarantine) শব্দটি ইতালীয় “কোয়ারান্টা জিওরনি (quaranta giorni)” থেকে এসেছে, যার অর্থ ৪০ দিন।
এখানে সেই অতীতের মহামারীগুলির কয়েকটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হল:-
০১। অ্যানটোনাইন প্লেগ (Antonine Plague)
সংগঠিত সাল= ১৬৫ খ্রি:
মোট মৃত্যু = ৫০ লক্ষ।
এই রোগের লক্ষণ ছিল জ্বর, গলা ব্যথা, কফ ইত্যাদি।
এশিয়া মাইনর (ছোট এশিয়া – বর্তমান তুর্কিস্থান), গ্রীস, মিশর, ইটালি এই মহামারীতে আক্রান্ত হয়।
এই মহামারীর উৎস, বাহক এখনও জানা যায়নি, তবে বিজ্ঞানীদের ধারনা এটি গুটি বসন্ত বা হাম থেকে হতে পারে।

০২। প্লেগ জাষ্টনিয়ান রোগ (The Plague of Justinian)
সংগঠিত সাল= ৫৪১-৫৪৯ খ্রি:
মোট মৃত্যু = ৭.৫০ কোটি হতে ২০ কোটির মধ্যে।
এটিই প্রথম প্লেগের রেকর্ড হওয়ার ঘটনা। বাইজেন্টাইন প্রথম সম্রাট জাস্টিনিয়ান, যিনি এই রোগে প্রথম আক্রান্ত হন এবং ভাল হয়ে যান। তাই তার নাম অনুসারে এই রোগের নাম করণ করা হয়। রোগটি ইয়ার্সিনিয়া পেস্টিস (Bacterium, Yersinia pestis) নামক ব্যাকটিরিয়া বহনকারী ইঁদুর দ্বারা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইঁদুরগুলি শস্যের জাহাজে এবং শস্যের গাড়িতে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে।


বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে কনস্টান্টিনোপল (আধুনিক ইস্তাম্বুল) অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। প্রাচীন ঐতিহাসিকদের মতে, মহামারীটির কারনে সেখানে একদিনে ১০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল,, যদিও আধুনিক ইতিহাসবিদরা বলেছেন যে সংখ্যাটি সম্ভবত ৫০০০ এর কাছাকাছি ছিল।


তবে এটি কনস্ট্যান্টিনোপলে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি সমগ্র সাম্রাজ্যে তখন ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন যুদ্ধ এবং বাণিজ্য দ্বারা ছড়িয়ে পড়া সহজতর হয়েছিল এবং সামাজ্যের প্রায় ২৫ শতাংশ লোককে হত্যা করেছিল।
এই রোগটি প্রতি ১২ বছর বা কিছু আগে পরে প্রায় ৭৫০ খ্রি: অবধি প্রত্যাবর্তন করত, অবশেষে ইউরোপের জনসংখ্যার অর্ধেক জনসংখ্যার (প্রায় ১০ কোটি লোক) মারা গিয়েছিল।
০৩। বুবোনিক প্লেগ – কালো মৃত্যু (Bubonic Plague or the Black Death)
সংগঠিত সাল= ১৩৪৬-১৩৫৩ খ্রি:
মোট মৃত্যু = ৭.৫০ কোটি হতে ২০ কোটির মধ্যে।
ব্লাক ডেথ ইউরোপকে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করেছিল।
এ রোগটিও প্লেগ জাষ্টনিয়ানের মত ইঁদুর দ্বারা সংক্রামিত “ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস” নামক ব্যাকটিরিয়া দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল
ব্লাক ডেথ ইতিহাসে রেকর্ড করা মহামারীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্বক মরণব্যধী। ইহা তখন ইউরোপের সাথে আফ্রিকা এবং এশিয়াকে বিধ্বস্ত করেছে এবং তখন এই রোগে ৭.৫০ কোটি হতে ২০.০০ কোটি লোক মারা গিয়েছে। বানিজ্যিক জাহাজে ইঁদুর বাহিতের মাধ্যমে ইহা মহাদেশ হতে মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।



এই ভাইরাস সংক্রামণের পরে ত্বকে এক প্রকার কালো দাগ পড়ত বিধায় ইহাকে ব্ল্যাক ডেথের নাম দেওয়া হয়েছিল।
ছবিতে ব্লাকডেথ প্লেগ রোগে আক্রান্ত এক ব্যক্তির হাতের আগুল কালো হতে দেখা যায়, তারপর সমস্ত শরীর কালো হয়ে মারা যেত; Photo Credit: Content Providers(s): CDC Original uploaderL M123 at en.wikipedia – This media comes from the Centers for Disease Control and Prevention’s Public Health Image Library (PHIL),
বিভিন্ন বিবরণ হতে জানা যায় যে, ইউরোপে ব্ল্যাক ডেথের প্রথম প্রাদুর্ভাব হয়েছিল ক্রিমিয়ান উপদ্বীপের কাফায়।
১৩৪৬ সালে, এই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রটি মঙ্গোল সেনাবাহিনী দ্বারা অবরোধ করা হয়েছিল, যারা তখন সমগ্র এশিয়া জুড়ে জয় করেছিল।
ইহাতে অনেক সৈন্য অবশ্য প্লেগ দ্বারা সংক্রামিত হয়েছিল। তৎপেক্ষিতে আক্রান্ত সৈন্যদের অনেকে আত্মহত্যা করলে, সেনাবাহিনী তাদের দেহগুলি শহরের দেয়ালের উপরে ছড়িয়ে দেয়, যার ফলে শহরের অভ্যন্তরে বসবাসকারী লোকেরা সংক্রামিত হয়।

০৪। তৃতীয় কলেরা মহামারী (The Third Cholera Pandemic)
সংগঠিত সাল = ১৮৫২-১৮৬০ খ্রি:
মোট মৃত্যু = ১০ লক্ষ (আনুমানিক)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর তথ্য মতে এ পর্যন্ত বিশ্বে ৭ টি কলেরা মহামারী হয়েছিল। তার মধ্যে যে মহামারীটি বিশ্বে বেশী প্রভাব ফেলেছিল তা হল ১৮৫২ সালের ৩য় কলেরা মহামারীটি।
এটি ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম দেখা দেয়, তারপর তা এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং আফ্রিকার অন্যান্য অংশগুলোতে ছড়িয়ে পরে। “

”ভিলেরিও ব্যাকটোরিয়া (bacterium, Vibrio cholera) কলেরা জীবাণু যা পানি বাহিত এবং দূষিত খাবার খাওয়া বা পানি পান করার ফলে কলেরা হয়।
যদি সময় মত চিকিৎসা নেয়া না হয় তবে এটি তীব্র ডায়রিয়াল রোগের কারণ হতে পারে এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যেতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর তথ্য মতে, প্রতি বছর এখনও কলেরাতে ১৩ লক্ষ হতে ৪০ লক্ষ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয় এবং ২১,০০০ হতে ১৪৩,০০০ এর মধ্যে লোকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

০৫। ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বর মহামারী (Flu Pandemic)
সংগঠিত সাল = ১৮৮৯-১৮৯০ খ্রি:
মোট মৃত্যু = ১০ লক্ষ (ন্যূনতম)।
ইহাকে উনিশ শতকের শেষ মহামারী বলা হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জার এই বিশেষ মহামারীটি “এশিয়াটিক ফ্লু (Asiatic Flu) ” বা “রাশিয়ান ফ্লু (Russian Flu” হিসাবে পরিচিত। সম্ভবত এটি রাশিয়ান সাম্রাজ্যের মধ্য এশীয় অঞ্চলে উৎপত্তি হয়েছিল।

মহামারীটি রেলপথের যোগাযোগ এবং নৌকায় করে ট্রান্স্য- আটল্যান্টিক যোগাযোগ এর মাধ্যমে দ্রুত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে, এই গ্রহটি আক্রান্ত হতে তখন মাত্র চার মাস সময় লেগেছিল, সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রাথমিক চূড়ান্তভাবে আক্রান্তের মাত্র ৭০ দিনের মাথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রান্তের দিক দিয়ে শীর্ষে স্থানে পৌঁছে।
০৬। ষষ্ঠ কলেরা মহামারী (The Sixth Cholera Pandemic)
সংগঠিত সাল = ১৮৯৯-১৯২৩ খ্রি:
মোট মৃত্যু = ৮ লক্ষ (আনুমানিক)।
এই মহামারীটি ভারতে উৎপত্তি হয় এবং বেশ কয়েকটি উত্থানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
এই মহামারীটি পরবর্তীতে মধ্য প্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপ এবং রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
কলেরা সংক্রমণ পরিষ্কার জল এবং স্যানিটেশন সুবিধার অপ্রতুলতার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। দূষিত খাবার বা জল খাওয়ার পরে কোনও ব্যক্তির মধ্যে এর লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এর লক্ষণ দেখা দিতে ১২ ঘন্টা থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে সময় লাগে।

০৭। ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বর মহামারী (Flu Pandemic)
সংগঠিত সাল = ১৯১৮-১৯১৯ খ্রি:
মোট মৃত্যু = ২ কোটি হতে ১০ কোটি (আনুমানিক)।
এই ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রথম ১৯১৮ সালের প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় বসন্তে মার্কিন সেনাদের মধ্যে প্রথম চিহ্নিত হওয়ার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছিল। অত:পর ইহা বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে এবং তখন বিশ্ব জনসংখ্যার কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশকে সংক্রামিত করে।
বিজ্ঞান তখন এত উন্নত না থাকায় প্রকৃত মৃতের সংখ্যা অজানা, অনেকের ধারণা এটি ৫ কোটিরও বেশি এবং কারো কারো ধারণা এটি ১০ কোটির কিছুটা বেশি মারা গিয়েছে, যা ব্ল্যাক ডেথের পর সবচেয়ে মারাত্মক মহামারী হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
যদিও গবেষকরা এই রোগের ভৌগলিক উৎস সনাক্ত করতে পারেনি, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, এটি “স্প্যানিশ ফ্লু (Spanish flu)” নামে অভিহিত করা হয়েছিল,এর কারণ স্পেনে এই রোগে আক্রান্তের খবর ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, কারণ স্পেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (World War I) এর সাথে জড়িত ছিল না।

এই প্রাদুর্ভাবের তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়টি ছিল স্বাস্থ্যকর প্রাপ্তবয়স্করা কম আক্রান্ত হয়েছিল এবং কিশোর-কিশোরীরা বেশি আক্রান্ত হয়েছিল।
কোনও ভ্যাকসিন ছাড়াই এই মহামারীটি দুটি ধাপে সংঘটিত হয়। দ্বিতীয় ধাপটি প্রথমটি অপেক্ষা ভয়াবহ ছিল। বিশ্ব যুদ্ধ হতে ফিরে আসা সৈন্যরা দ্বিতীয় তরঙ্গে বেশী আক্রান্ত হয়ে মৃত্যবরণ করেছিল।
তখন মহামারী প্রতিরোধের উপায় হিসাবে জনসমাবেশগুলোতে বিছিন্নতা (quarantines), মুখোশ (masks) পরা এবং মানুষের জনসমাগমের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।
ধারণা করা হয় যে, এই ব্যবস্থাগুলো এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি যৌথভাবে মহামারীটি নির্মূল করতে সহায়তা করেছিল। যদিও এমন একটি তত্ত্বও রয়েছে যে, ভাইরাসটি দ্রুত দূর্বল হওয়ার কারণে মৃত্যুর তীব্রতার হ্রাস ঘটে।
০৮। গুটি বসন্ত মহামারী (The smallpox)
সংগঠিত সাল = খৃষ্টপূর্ব ৩য শতাব্দির পূর্ব হতে – ১৯৮০ (পৃথিবী হতে নির্মূল)
মোট মৃত্যু = ২.৫০ কোটি হতে ৫ কোটি।
এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ৩০% ছিল, শিশুদের মধ্যে আক্রান্তের উচ্চ হার ছিল । যারা বেঁচে গিয়েছিল তাদের ত্বকের ব্যাপক ক্ষত ছিল এবং আক্রান্তদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ অন্ধ হয়ে যেত।
দুটি ভাইরাস ভারিওলা মেজর এবং ভারিওলা মাইনর (Variola major and Variola minor)পরিবর্তিত হয়ে এই রোগের কারণ হয়েছিল।
এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলির মধ্যে জ্বর এবং বমিভাব ছিল। তারপরে মুখে ঘা এবং ত্বকের উপর ফুসকুড়ি তৈরি হযত। বেশ কয়েকটি দিন ধরে ত্বকের ফুসকুড়িগুলোর কেন্দ্রস্থলে একটি ছিদ্র দেখা দিত এবং উহা হতে এক প্রকার তরল নির্গত হত। এরপরে দাগ পড়ে যেত।

১৯৭৩ সালে গুটি বসন্তে আক্রান্ত বাংলাদেশী একটি শিশু; গুটি বসন্তে একজন লোকের মূখে দাগ ও অন্ধত্ব, কয়েকজনের হাতে-পায়ে- শরীরে দাগের চিহ্ন:
এই রোগের ইতিহাস অজানা। এই রোগের প্রথম প্রমাণ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর মিশরীয় মমিগুলিতে পর্যন্ত রয়েছে। অনুমান করা হয় যে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে প্রতি বছর এই রোগে ৪,০০,০০০ লোক মারা যেত এবং এক-তৃতীয়াংশ অন্ধত্বে পরিনত হত। এই মৃত্যুর মধ্যে ছয় রাজা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই রোগের প্রতিরোধে প্রাথমিকভাবে ভ্যাকসিন ও এন্টিভাইরাল ঔষধ ব্যবহার হত। ১৯৬৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ রোগ বিনাশের পরিকল্পনা গ্রহন করে। ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে সর্বশেষে এক ব্যক্তি এই রোগে আক্রান্ত হয়।
১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই রোগ পৃথিবী হতে বিনাশের ঘোষণা দেয়। তবে ল্যবরোটরিতে গবেষণার জন্য এই রোগের জীবানু সংরক্ষণ করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে যে, যুদ্ধের অস্র হিসাবে এই রোগের জীবানু ব্যবহৃত হত।
০৯। এশিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বর মহামারী (Asian Flu Pandemic)
সংগঠিত সাল = ১৯৫৬-১৯৫৮ খ্রি:
মোট মৃত্যু = ন্যূনতম ১১ লক্ষ।
১৯৫৬ সালে চীনে এই মহামারীটি প্রথম সনাক্ত হয়। তারপর চীন হতে এটি সিঙ্গাপুর, হংকং এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫৭ সালে এটি ভারতে ছড়িয়ে পড়ার খবর রয়েছে।
সমীক্ষায় সুপারিশ করা হয়েছিল যে মহামারীটি এভিয়ান এবং মানব ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের স্ট্রেন থেকে উৎপন্ন হয়েছিল, যা Influenza A – H2N2 subtype ভাইরাস।
এই রোগের লক্ষণগুলোর মধ্যে পা ঠাণ্ডা ও দূর্বল হয়ে যাওয়া, গলা ব্যথা, নাক দিয়ে শ্লেষা, পানি ঝরা, এবং কফ ও কাঁশি এবং দূর্বলতা অনুভব করা। ভাইরাসের সংস্পর্শের পরপরই এ লক্ষণগুলো উপস্থিত হত।
এই প্রাদুর্ভাবের দুটি তরঙ্গ ছিল, তবে ১৯৫৭ সালের আগস্টে একটি ভ্যাকসিন আবিস্কার ও প্রয়োগের পরে সংক্রমণ বন্ধ হয়ে যায়।
১০। হংকং ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বর মহামারী (Hong Kong Flu Pandemic)
সংগঠিত সাল = ১৯৬৮ খ্রি:
মোট মৃত্যু = ন্যূনতম ১০ লক্ষ।
১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে এ মহামারীটি হংকংয়ে প্রথম দেখা দেয়, তারপর সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামে এর প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং ১২ সপ্তাহের মধ্যে আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, আনুমানিক এক লক্ষ লোক এই মহামারীতে মারা গিয়েছিল
এই মহামারী ভাইরাসটি ছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা এ – এইচ৩এন২, এইচ২এন২ এর উপ টাইপ (Influenza A – H3N2, subtype of H2N2), যা ১৯৫৬ সালে পূর্ববর্তী এশিয়ান ফ্লুর পরিবর্তনের ফলে অ্যান্টিজেনিক শিফট নামে একটি প্রক্রিয়া সম্ভবত এইচ 3 এন 2 এর পরিবর্তনের জন্ম দেয়, এতে ভাইরাসের পরিবর্তন ঘটে।
এই মহামারীতে মৃত্যুর হার আগের ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রাদুর্ভাবের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম ছিল এবং যা ছিল আক্রান্তের ০.৫ শতাংশেরও নীচে।
এটি সম্ভবত যে লোকেরা পূর্বের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর সংস্পর্শে এসেছিল তাদের শরীরে এই ভাইরাস প্রতিরোধে অ্যান্টিবডি (Antibody) তৈয়ার হওয়ায় এই বিশেষ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর ভাইরাসটিকে পরাভূত করা সহজ হয়েছিল।
উন্নত চিকিৎসা সেবার প্রচলন এবং অ্যান্টিবায়োটিকের সহজলভ্যতাও এ রোগের ছড়িয়ে পড়ার গতিকে হ্রাস করেছে। এইচ৩এন২ ভাইরাসটি (H3N2 virus) আজও ইনফ্লুয়েঞ্জা হিসাবে বিদ্যমান রয়েছে যা মৌসুমী ইনফ্লুয়েঞ্জা (seasonal influenza) হিসাবে পরিচিত।

১১। এইচআইভি/ এইডস্ মহামারী (HIV/Aids Pandemic)
সংগঠিত সাল = ১৯৮১ খ্রি: – চলমান
এ পর্যন্ত মৃত্যু = ৩ কোটি ২০ লক্ষ।
ভাইরাসটির নাম হলো হিউম্যান ইমিউনোডেফিসি ভাইরাস (Human Immunodeficiency Virus -HIV) যার অর্থ হ’ল মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসকারী ভাইরাস।
এই ভাইরাস মানব দেহে প্রবেশ করে রক্তের রোগ প্রতিরোধকারী এমন সব শ্বেতকনিকাসমূহকে (White Cells) আক্রমণ করে যারা মানবদেহে রোগজীবানুর বিরুদ্ধে লড়াই করে। যদি এই ভাইরাসের চিকিৎসা করা না হয় তবে তা হতে এইডস রোগ হতে পারে।
ভাইরাসটি মানবদেহের রোগজীবানুর বিরুদ্ধে লড়াকু সৈনিক শ্বেতকণিকার সিডি৪ কোষ বা টি-হেলপার (CD4 cell or T-Helper) কে আক্রমণ করে এবং উহাদের ভিতরে ডুকে কোষের জেনেটিক বস্তুগুলোকে ব্যবহার করে ভাইরাসটি অনুরূপ ভাইরাস তৈয়ার করতে থাকে।
ফলে শ্বেত কনিকাটি মারা যায়। ক্রমাগতভাবে শ্বেত কনিকার মৃত্যু এবং ভাইরাসের জ্যামিতিক হারে বংশ বৃদ্ধিতে ধীরে ধীরে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে এবং এইডস্ রোগে আক্রান্ত হয়।
উল্লেখ্য যে, করোনাভাইরাসও একই প্রক্রিয়ায় মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (immune system) হ্রাস করে দেয়।
এইডস বিষয়ে প্রথম ১৯৮১ সালে রিপোর্ট করা হয়।
অরক্ষিত যৌনাচার, এইচআইভি সংক্রামিত ব্যক্তির ব্যবহৃত ইনজেকশন সূঁচ অন্য কোন ব্যক্তির দেহে ব্যবহার করা হলে কিংবা আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের সাথে অন্য ব্যক্তির রক্ত সংক্রমণে মানুষ থেকে মানুষে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে।
এইডস এর কারণে প্রতি বছর প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আফ্রিকার কয়েকটি অঞ্চলে এ ভাইরাসে প্রকোপ বেশী এবং ঐ সকল অঞ্চল মহামারী হিসাবে চিহ্নিত রয়েছে।
সেখানে প্রতি ২৫ জনের মধ্যে একজন হ’ল এইচআইভিতে আক্রান্ত এবং বিশ্বব্যাপী দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি লোককে এইচআইভি সংক্রামণ পরীক্ষার আওতায় আনা হয়েছে।
২০১৮ সালের হিসাবে বিশ্বের প্রায় ৩.৩৭ কোটি লোক এই ভাইরাসে আক্রান্ত । তর্মধ্যে ৩.৬২ কোটি বয়স্ক এবং ১১৭ লক্ষ শিশু (যাদের বেয়স ১৫ বছরের নীচে)।

১২। সার্স মহামারী (Severe Acute Respiratory Syndrome -SARS)
সংগঠিত সাল = ২০০২-২০০৩খ্রি:
মোট মৃত্যু = ৭৭৪।
করোনাভাইরাস পরিবারের আবিস্কৃত প্রথম ভাইরাস এবং ইহার দাপ্তরিক নাম Severe Acute Respiratory Syndrome -SARS ও কারিগরিক নাম SARS-CoV।
ধারণা করা হয় যে বাদুরের মাধ্যমে জলাশয়ের পশুতে (খট্টাস বা গন্ধগোকুল) এবং তথা হতে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। দক্ষিণ চীনের গোংদুন প্রদেশে প্রথম এর আর্ভিভাব ঘটে।
সার্স ২৬ টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ৮,০০০ মানুষ এ ভাইরাসে সংক্রামিত হয়েছে, যদিও অন্যান্য মহামারীগুলোর তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা খুব কম বলে বিবেচিত।

এ ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণগুলো হ’ল ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মত জ্বর, মাথাব্যথা, ডায়রিয়া।
এ ভাইরাসে সিঙ্গাপুর, হংকং এবং তাইওয়ান সবচেয়ে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়।
১৩। মার্স মহামারী (Middle East Respiratory Syndrome MERS)
সংগঠিত সাল = ২০১২-
মোট মৃত্যু = ৮৫৮
করোনাভাইরাস পরিবারের আবিস্কৃত ২য় ভাইরাস এবং ইহার দাপ্তরিক নাম Middle East Respiratory Syndrome -MERS ও কারিগরিক নাম MERS-CoV। উটের মাধ্যমে ইহা ছড়ায় বলে ইহাকে উট জ্বর বা camel flu বলা হয়।
করোনাভাইরাসের স্ট্রেন মার্স-কোভিড প্রথম ২০১২ সালে সৌদি আরবে চিহ্নিত হয়।
মার্স হ’ল একটি ভাইরাল শ্বাস প্রশ্বাসের রোগ যার লক্ষণগুলো জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট ।
২০২০ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত ২,৫৯৯ জন লোক এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। অন্যান্য করোনভাইরাসগুলোর তুলনায় এই করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার মারাত্মক ভাবে অধিক এবং আক্রান্তের প্রায় ৩৫ শতাংশ মারা যাচ্ছে।

মানবদেহে ভাইরাস ছড়ানোর উৎসসমূহ এবং পরের ভাইরাসটি কি?
জলবায়ুর পরিবর্তন: কভিড-১৯ করোনাভাইরাস দিয়ে মানব জাতির লড়াই মাত্র শুরু- আরও অনেকগুলো মহামারী আসছে
Source: Al Jazeera News, WIKIPEDIA, WHO, FOREIGNER.FI