হাতি- দুই বর্ণের ছোট্ট একটি নাম। স্থলভাগের প্রাণীর মধ্যে সবচেয়ে বড়। একটি পূর্ণবয়স্ক হাতির আবাসস্থল ৪০ থেকে ৮০০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। দেশে বর্তমানে আনুমানিক ২৬৮টি হাতির বিচরণের কথা শোনা যায়। এত সংখ্যক হাতির বিচরণের জন্য যে পরিমাণ বনভূমি দরকার, তা সংশ্নিষ্ট এলাকাগুলোতে নেই। তাদের চলার পথ তো বটে, বাসস্থানও এখন মানুষের কব্জায়। খাবারও কমে গেছে। ফলে হাতি উঠে আসছে মূল জনপদে। বাড়ছে হাতি-মানুষ সংঘাত। ক্ষতির শিকার উভয়েই।
এ পরিস্থিতিতে আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে হাতি দিবস। হাতির জন্য টেকসই পরিবেশ, তাদের খাদ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে দিবসটির গুরুত্ব রয়েছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এ উপলক্ষে দেশে কোনো কর্মসূচির খবর পাওয়া যায়নি। তবে আন্তর্জাতিক উদ্যোগে ভার্চুয়াল আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে। হাতি গবেষকরা বলছেন, একটি হাতি একটানা হেঁটে কক্সবাজার থেকে বান্দরবান পর্যন্ত চলে যেতে পারে। কিন্তু তাদের চলার পথ কণ্টক। বন যেমন উজাড় হয়েছে, বন্ধ হয়েছে একের পর এক করিডোর। কোথাও বনের ভেতর দিয়ে গেছে রেলপথ, কোথাও ঘনবসতি। নানা স্থাপনা এবং মানুষের স্বভাবগত প্রাণীবিরুদ্ধ ভূমিকায় হাতি এখন মহাবিপন্ন প্রাণী।
গবেষকরা আরও বলছেন, বড় প্রাণীর জন্য বড় জায়গা দরকার। কিন্তু হাতির নিয়মিত আবাসস্থলই সংকুচিত হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জায়গা দিতে টেকনাফে বিস্তীর্ণ বনভূমি উজাড় হয়েছে; যেগুলো হাতির আবাসস্থল ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে হাতির খাবারের সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এশিয়ান হাতিকে মহাবিপন্নের তালিকায় তুলেছে। সংস্থাটির জরিপে দেখা গেছে, নব্বই দশকেও দেশে হাতির অবাধ বিচরণ ছিল। মানুষের সঙ্গে সংঘাত ছিল না, প্রাণহানিও কম ছিল। একবিংশ শতাব্দীতে এসে হাতি এবং মানুষের মৃত্যুর হার বাড়তে শুরু করে। গত দেড় যুগে বন্যহাতির আক্রমণে তিন শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। মানুষের সংঘবদ্ধ হামলায় প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ১০০টি হাতি। আরও নানা কারণে হাতির মৃত্যু হয়েছে। এমনকি করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও গত ছয় মাসে মারা গেছে কমপক্ষে ১০টি হাতি।
আইইউসিএনের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ রাকিবুল আমিন সমকালকে বলেন, তাদের হিসাবে বর্তমানে দেশে হাতির সংখ্যা আনুমানিক ২৬৮টি। প্রাণীটির আন্তর্জাতিক করিডোর বেশি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতার এবং মাইন পুঁতে রাখায় অনেক হাতি এপারে আটকা পড়েছে। তারা না পারছে মিয়ানমারে ফিরতে, না পারছে কক্সবাজারের ছোট্ট বনভূমিতে প্রয়োজনীয় খাদ্য সংস্থান করতে।
হাতির সুরক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প নেওয়ার ওপর জোর দিয়ে রাকিবুল বলেন, ‘মহাবিপন্ন প্রাণীটিকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ নজর দিতে হবে। হাতির বাসস্থান ও বনের আশপাশে যারা বসবাস করে তাদের সচেতন করার পাশাপাশি তাদের অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, বনের ভেতরেই সরকারের নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। হাতি যেসব জায়গা দিয়ে চলাচল করত, সেখানেই চলছে মহাযজ্ঞ। অনেকের ঘরবাড়িও হয়ে গেছে। ফলে হাতি উঠে আসছে মূল লোকালয়ে। তখনই মানুষের সঙ্গে তৈরি হয় সংঘাত।
তবে এ ক্ষেত্রে মানুষের আক্রমণাত্মক মনোভাবকে দায়ী করেছেন হাতি গবেষক ড. আনিসুজ্জামান খান। তিনি সমকালকে বলেন, ‘যে কোনো বন্যপ্রাণী দেখলে মানুষ তাড়া করতে পছন্দ করে। তা হোক টিকটিকি কিংবা সাপ-শিয়াল। সত্যি বলতে, হাতি কখনও মানুষের কাছে আসে না, বরং মানুষই হাতিকে তাদের আবাসস্থলে গিয়ে বিরক্ত করে।’
অন্যদিকে, শুধু আন্তর্জাতিক অভিবাসন নয়, হাতি দলবেঁধে স্থানীয়ভাবে মাইগ্রেট করে বলে জানান ড. আনিসুজ্জামান। তিনি বলেন, হাতিরা বন থেকে বনে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এক বন থেকে আরেক বনে যাওয়ার যে নিয়মিত করিডোর, সেখানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। অথবা দেখা যায়, হাতি যে পথ ধরে যাচ্ছে, মানুষও সে পথে ভিড় করছে। এর ফলশ্রুতিতে মানুষ মারা যাচ্ছে, আক্রমণের শিকার হাতিও।
হাতি সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাকে ‘কাগুজে’ বলে মনে করেন আনিসুজ্জামান। তার মতে, বন বিভাগে ‘ডেডিকেটেড’ কর্মকর্তা দরকার, যারা সারাজীবন হাতির পেছনেই কাটাবেন। ভারত ও শ্রীলঙ্কায় এমনটি দেখা যায়। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে উচ্চমাপের প্রশিক্ষণ দিয়ে হাতির জন্য নিবেদিত মানুষদের কাজে লাগাতে হবে। শুধু প্রকল্প গ্রহণ করলেই হবে না, হাতি সুরক্ষায় কী কাজ করা দরকার, সেটি আগে সুস্পষ্ট করতে হবে।