আইন কমিশনের ছাদ যেন শান্ত করে রেখেছে প্রকৃতিকে
আকাশে চলছে মেঘ-রোদের খেলা। চারদিকে যান্ত্রিক কোলাহল। আকাশচুম্বী হয়ে আছে গায়ে গায়ে লেগে থাকা সরকারি বহুতল সব ভবন। তবে এর মধ্যে আইন কমিশন ভবনের ছাদ যেন যান্ত্রিকতাকে দূরে ঠেলে শান্ত করে রেখেছে প্রকৃতিকে। ভবনের ছাদজুড়ে গড়ে উঠেছে এক টুকরো বাগান।
যেখানে ফুল-ফলসহ প্রায় তিন হাজার গাছের সমাহার। মাঝেমধ্যে পাখিরা এসে গাছের ডালে বসে জিরোয় আবার ডানা মেলে উড়ে যায় অদূরে। প্রজাপতিরাও উড়ে উড়ে মধু খেয়ে শোভাবর্ধনের কাজ করে। বারোতলা ভবনের চোখজুড়ানো ছাদটি যেন এক টুকরো স্বর্গরাজ্য।
বাগানটিতে গেলে বোঝা যায়, অনেকটা শখ আর প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে এই ছাদ-বাগান। প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে বাগানটি গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক।
বাগানটি ঘুরে দেখা গেছে, ভবনটির ছাদের চারপাশ সেজে আছে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় গাছে। চলাচলের দূরত্ব ঠিক রেখে ছাদের ফ্লোরে থাকা টবগুলোতে লাগানো হয়েছে গাছ। তবে বাদ যায়নি ছাদের রেলিংও।
চারপাশের রেলিংয়ের সঙ্গে মিশিয়ে ছোট গাছ লাগানোর জন্য বেড তৈরি করা হয়েছে। সেখানে শোভা পাচ্ছে হরেক রঙের ফুল আর ফলের গাছ। অর্থাৎ, বাগানজুড়ে একটি আদর্শ পরিকল্পনার প্রতিফলন ঘটেছে। আবার বেডগুলোতে টাইলস দিয়ে ভিন্ন রূপ দেওয়া হয়েছে। চাইলে যে কেউ একটু অবসরে সেখানে বসে সময় কাটাতে পারেন।
শখ পূরণ হলেও বাগানটির পরিচর্যার বিষয়টি এখনও হাতছাড়া করেননি সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। কাজের ফুরসত মিললে নিজেই ছাদে উঠে বাগানের পরিচর্যার বিষয়টি তদারকি করেন তিনি।
বাগানটিকে ঘিরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক জানান, বাগান করার বিষয়ে ছোটবেলা থেকেই আমার আগ্রহ কাজ করতো। বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ভবনের তলা বর্ধিতকরণের সময় ২০১৮ সালে ইঞ্জিনিয়ারকে ছাদে বাগান লাগানোর মতো করে ভবনটির (আইন কমিশন) ছাদ নির্মাণ করতে বলেছিলাম।
বাগানটির জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে চারা সংগ্রহ করেছিলাম। নিজের অর্থায়নেই বাগানটি সাজানো শুরু করি। যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেছি। খামারবাড়িতে মাহমুদ নামে এক ভদ্রলোক চাকরি করতেন, শুরুর দিকে তিনিও বিনামূল্যে আমাকে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন।
‘তবে খরচ সামলাতে একটু মুশকিল হয়ে যায়। অডিট বিভাগকে বলেছিলাম কীভাবে গাছের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া যায়। তারা আমাদের অন্যান্য খাতে বাজেট দেখাতে বলেছিল।
মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার বেশি লাগে না। তবে প্রথম দিকে খরচটা একটু বেশি ছিল। এখন বছরে দুবার গাছ কেনা হয়। আগামী জুলাই মাস থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সহযোগিতা আসবে’, বলেন তিনি।
খায়রুল হক বলেন, ‘আমি বাগানের ছবি তুলে প্রধানমন্ত্রীকেও দেখিয়েছিলাম। তিনি বেশ খুশি ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। জীবদ্দশায় বিচারপতি আনোয়ারুল হক দুটি গাছ দিয়েছিলেন। গাছ দুটির পাশে তার নামফলক স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি।’
আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এ বি এম খায়রুল হক বলেন, ‘আইন কমিশনে যেসব বিচারপতি ও বিদেশি ব্যক্তিত্ব আসেন, তাদের সবাইকেই আমি বাগানটিতে নিয়ে যাই।
তারা আনন্দবোধ করেন। আইন কমিশনের আমার যত কর্মকর্তা রয়েছেন, তারাও বাগানের পরিচর্যার বিষয়ে আমাকে বেশ সহযোগিতা করেন।’
তিনি বলেন, ‘আবুল হোসেন নামে একজন মালি হিসেবে কাজ করছেন। কাজটি করতে এসে তার আয়ের তুলনায় লোকসানই বেশি হয়। তবে তিনি আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করেন।
বর্তমানে বাগানটির এক পাশে ঘর করে প্রায় ৪০টি কবুতর রাখা হয়েছে। ফুলগুলোয় প্রায়ই মৌমাছি এসে বসে। বিকাল থেকে সন্ধ্যা নাগাদ বাগানটিতে পাখির সমারোহ হয়।’
নগরবাসীকে আহ্বান জানিয়ে সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সবারই উচিত নিজের ছাদে সহনশীলতার মধ্যে রেখে ছোট ছোট গাছ রোপণ করা। এতে পরিবেশ সুন্দর হবে এবং আমাদের মানসিক প্রবৃদ্ধিও ঘটবে।
ছাদ না থাকলে ঘরের বারান্দায়ও সাধ্যমতো গাছ লাগানো যেতে পারে। এতে ঘরের শিশুটিও পরিবেশকে ভালোবেসে বেড়ে উঠতে পারবে।’