অবশেষে পাওয়া গেলো ঢাকার আকাশে রহস্যময় মিথেন গ্যাসের মূল উৎস
জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে মিথেন গ্যাসের নির্গমন কমানো খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। জীবন আছে এরকম পদার্থ পঁচে এই মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। এটি একটি প্রাকৃতিক গ্যাস।
কার্বন ডাই অক্সাইডের (CO2) মতো নয় মিথেন গ্যাস। এবং এই গ্যাস বায়ুমণ্ডলে খুবই অল্প সময়ের জন্য থাকে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এটি কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতিকর।করোনাভাইরাস মহামারির লকডাউন থাকা সত্ত্বেও গত বছর বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস পাওয়া গেছে সেটা একটা রেকর্ড।
এবছরের এপ্রিল মাসে ব্লুমবার্গ মিডিয়ায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে বিশ্বে যেসব দেশ আছে তার মধ্যে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে। যা পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
প্যারিসভিত্তিক কোম্পানি কেরস এসএএস স্যাটেলাইট (Satellite) থেকে তোলা ছবি ও তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা মিথেনের অন্যতম উৎস হিসেবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে চিহ্নিত করেছে। আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের গবেষণায় একই ধরনের ফলাফল পেয়েছে। ব্লুফিল্ড টেকনোলজিসের প্রতিষ্ঠাতা ইওতাম এরিয়েল বলেছেন, তাদের বিশ্লেষণেও দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমানে মিথেন উৎপন্ন হচ্ছে।এই গ্যাসের উৎস সম্পর্কে কিছু ধারনা দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে – ধান ক্ষেত, ময়লা আবর্জনার ভাগাড় বা ল্যান্ডফিল, কয়লার মজুদ, পাইপলাইনের ছিদ্র দিয়ে প্রাকৃতিক গ্যাস বাইরে বের হয়ে আসা ইত্যাদি।
তবে বাংলাদেশের অনেক বিজ্ঞানী বলছেন, স্যাটেলাইটের (Satellite) তোলা ছবিতে যে মিথেন গ্যাস দেখা যাচ্ছে, তার উৎস যে বাংলাদেশ তার পক্ষে বৈজ্ঞানিক কোন প্রমাণ নেই।
ব্লুমবার্গের এই রিপোর্টটি দেখেছেন লন্ডনের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাটাম হাউজে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক গবেষক ড. মালিহা মুজাম্মিল। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উপরে পাওয়া মিথেন গ্যাসের উৎস কী হতে পারে সেটা বলা খুব কঠিন। কারন, এই অঞ্চলের আরো অনেক দেশেই ধান চাষ হচ্ছে,আবর্জনার স্তুপ রয়েছে, ভরাট হচ্ছে জলাভূমি। তাই এই মিথেন গ্যাস যে বাংলাদেশেই উৎপন্ন হয়েছে সেটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।
ড. মুজাম্মিল বলেন, স্যাটেলাইটের ছবির ওপর নির্ভর করে এই এলাকাটি চিহ্নিত করা হয়েছে। যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া এটা সনাক্ত করা খুবই কঠিন। কার্বন আইসোটোপ বিশ্লেষণ করলে নিশ্চিত হওয়া যেত যে এই মিথেন গ্যাস কোথাথেকে এসেছে।
তিনি আরো বলেন, এর উৎস জানতে যেখানে যেখানে মিথেনের ঘনত্ব বেশি দেখা যায় সেখানে আরো গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে।
তবে স্যাটেলাইটের ছবি দেখে তার ধারণা হচ্ছে, যেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলার ভাগাড় বেশি আছে সেখানে মিথেনের ঘনত্ব অনেক বেশি।ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকায় এরকম বড় দুটো আবর্জনা ফেলার ভাগাড় বা ল্যান্ডফিল রয়েছে, যেখানে শহরের সব বর্জ্য নিয়ে ফেলা হয়। একটি ঢাকার দক্ষিণে মাতুয়াইলে যা প্রায় ২৫ বছরের পুরনো। এর আয়তন প্রায় ১০০ একর। অন্যটি উত্তরাঞ্চলীয় আমিনবাজার এলাকায় যা শুরু হয়েছে ২০০৭ সালে থেকে। এর আয়তন প্রায় ৫২ একর।
ড. মুজাম্মিল বলছেন, এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরো আধুনিক ও পরিবেশ-বান্ধব করে মিথেন গ্যাস নির্গমন কমানো সম্ভব। বিশেষ করে জৈব ও অজৈব বর্জ্য আলাদা করে ফেলতে হবে। রিসাইক্লিং করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
ভিয়েতনাম ও ভারতে অনেক বেশি ধান চাষ হয়। পার্শবর্তী দেশ ভারতে গরুর চাষ অনেক বেশি। সেকারণে অনেকেই বলছেন, এই মিথেন গ্যাস হয়তো অন্য কোন দেশেও উৎপন্ন হতে পারে এবং সেটা ভাসতে ভাসতে বাংলাদেশের উপরে এসে জড়ো হতে পারে।
কিন্তু ড. মালিহা মুজাম্মিল বলেছেন, তার কাছে এমন কিছুই মনে হয় না।
কারন, এর সম্ভাবনা খুব কম। মিথেন খুব হাল্কা একটি গ্যাস। বাংলাদেশের চেয়েও তার পার্শবর্তী দেশগুলোতে অনেক বেশি মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। কিন্তু সেসব দেশ থেকে যদি উড়ে এই গ্যাস বাংলাদেশের উপরে আসতো তাহলে এটা ঠিক একটা জায়গায় আটকে থাকতো না, এটা ছড়িয়ে যেত।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কার্বন ডাই অক্সাইডের তুলনায় মিথেন গ্যাস ৮৪ গুণ বেশি ক্ষতি করার সক্ষমতা রয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে অবশ্যই দুটো গ্যাসেরই নির্গমন কমাতে হবে।
বর্ণ ও গন্ধহীন এই মিথেন গ্যাস যখন আস্তে আস্তে উপরে উঠে যায় তখন সেটা তাপকে আটকে রাখে। এবং মিথেনের এই ক্ষমতা কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়েও অনেক গুণ বেশি। তাপকে আটকে রেখে এই গ্যাস বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রাকে অনেক গুন বাড়িয়ে দিচ্ছে যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান একটি কারণ।
এই মিথেন গ্যাস নির্গমন কিভাবে কমানো সম্ভব এবং বাংলাদেশ তাতে কী পরিমান ভূমিকা রাখতে পারে?
ড. মালিহা মুজাম্মিল বলছেন, “মিথেন গ্যাসের যেসব উৎস রয়েছে, যেমন ধান চাষ, আবর্জনার ভাগাড়, গ্যাস পাইপের ছিদ্র ও কয়লার মজুদ ইত্যাদি- এসব পরিবর্তনের ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে, কৃষি কাজে চাষের ক্ষেত্রে ফসলের বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। তাহলে হয়তো মিথেন গ্যাস নির্গমন কিছুটা কমে আসবে।”