“হাসপাতাল চাই, কিন্তু গাছ কেটে নয়!”
শতবর্ষী গাছ কেটে চট্টগ্রামের সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ নিয়ে চলছে বিতর্ক
চট্টগ্রাম নগরীর সিআরবি ভবনকে ঘিরে রয়েছে শতবর্ষী পুরনো গাছগাছালি আর ছোট বড় বেশ কিছু পাহাড়-টিলা। প্রাকৃতিক এই পরিবেশকে নগরবাসী চট্টগ্রামের ‘ফুসফুস’ বলে থাকেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সেখানে বড়সড় একটি হাসপাতাল নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করায় এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের বাধা এবং মতামতকে আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে সিআরবিতে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল এবং ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ নির্মাণের সকল আয়োজন প্রায় চূড়ান্ত।
ইতোমধ্যে, ইউনাইটেড হাসপাতাল পরিচালনা কর্তৃপক্ষ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে রেলওয়ে। ২০২০ সালের ১৮ মার্চ রেলের সঙ্গে চুক্তি করার পর এখন হাসপাতাল নির্মাণের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, বিদ্যমান হাসপাতালের পাশে ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ, ৫০ আসনের নার্সিং ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালটি আধুনিকায়ন করে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হবে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অপরিণামদর্শী এমন উদ্যোগে হতাশা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদ ও প্রকৃতিপ্রেমীরা।
কবি রিতু পারভী বলেন, সিআরবিতে এখনো পর্যন্ত টিকে আছে অনেক শতবর্ষী গাছগাছালি, অনেকগুলো পাহাড়। আছে ব্রিটিশ আমলে তৈরি স্থাপনা, যার মধ্যে রয়েছে স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক মূল্য।
তিনি আরো বলেন, স্বর্গসম এ জায়গাটিতে হাসপাতাল হলে এখান থেকে বিতাড়িত হবে প্রকৃতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণ, কাটা পড়বে গাছগাছালি গুলো, তৈরি হবে মেডিকেল বর্জ্য, গড়ে উঠবে দোকানপাট।
এদিকে চুক্তি করলেও সিআরবিতে হাসপাতাল চায় না খোদ রেলওয়ের শ্রমিক-কর্মচারীরা। এরই মধ্যে তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন।
তাদের বক্তব্য, তারা হাসপাতালের বিপক্ষে নন। তবে এই ধরনের হাসপাতাল তৈরী করার জন্য চট্টগ্রাম নগরীতে রেলওয়ের অনেক জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কিছু জমি আছে প্রভাবশালীরা দখল করে রেখেছেন। সেগুলো উদ্ধার করে হাসপাতাল করা যায়।
সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ প্রসঙ্গে কবি ও সাংবাদিক আবুল হাসেম বলেন, সিআরবিতে শুধু হাসপাতালই নয়, কোনো ধরনের স্থাপনাই হওয়া কোনভাবেই উচিত হবে না। মনে রাখতে হবে, এই স্থানটি হলো চট্টগ্রামের ফুসফুস। বুকভরে বাতাস নিতে এটাকে রক্ষা করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রামে ঢাকার মতো রমনা পার্ক নেই, বোটানিক্যাল গার্ডেনও নেই। গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত নয়নাভিরাম এই উন্মুক্ত পরিসরটিই যদি না থাকে, মানুষ তবে যাবে কোথায়!
সিআরবিকে চট্টগ্রামের কার্বন শোষণের প্রাকৃতিক কারখানা আখ্যায়িত করে বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও কর্ণফুলী গবেষক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, এখানে শতবর্ষী গর্জন ও রেইনট্রিসহ অনেক গাছ-গাছালি আছে। প্রাণ-প্রকৃতিতে ভরা এমন গণসামাজিক জায়গায় কংক্রিটের ভারী স্থাপনা নির্মাণ খুবই দুঃখজনক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, যে গাছ, পাহাড়-টিলা কেটে হাসপাতাল করা হচ্ছে, সে রকম গাছগাছালি কি আমরা লাগাতে পারছি?
তিনি আরো বলেন, সিআরবির প্রাকৃতিক এই পরিবেশ রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি। এটি শতবছরে গড়ে উঠেছে। অথচ রাতারাতি এই পরিবেশ ধ্বংসের আয়োজন করা হয়েছে। এখানে হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত নিতান্তই অবিবেচক।
হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ট্র্যাক) আহসান জাবীর বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী হাসপাতালের নকশা তৈরি করে আমাদের কাছে জমা দিয়েছে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ। নকশাটি চউক থেকে অনুমোদন নেওয়া হবে। এরপর প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু হবে।’
তিনি বলেন, এ মাসেই মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেই কাজ শুরু হবে।
পরিবেশবিদদের উদ্বেগের বিষয়ে তিনি বলেন, পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টি যাচাই করতে পরামর্শক নিয়োগ করেছে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ। রিপোর্ট পাওয়ার পর পরিবেশ রক্ষায় করণীয় নির্ধারণ করা হবে। আর শতবর্ষী গাছগুলো যাতে কাটা না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখা হবে।