শিশিরে ভেজা ঘাস আর কুয়াশার চাদর জানান দিল হেমন্ত এসেছে প্রকৃতিজুড়ে। আজ পয়লা কার্তিক।”সবুজ পাতার খামের ভেতর/হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন পাথারের ওপার থেকে/আনল ডেকে হেমন্তকে”।কবি সুফিয়া কামালের “হেমন্ত” কবিতায় হলুদ গাঁদায় চিঠি লেখে এভাবেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে হেমন্তকে। সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে আবহমান বাংলায় ষড় ঋতুর পরিক্রমায় এলো হেমন্ত।
শরতের পর কার্তিক-অগ্রহায়ণ মিলে হেমন্ত। নতুন ঋতুর আগমনে রূপ বদলায় প্রকৃতি। প্রকৃতির ম্লান, ধূসর ও অস্পষ্টতার অনুভূতি হানা দেয় চেতনলোকে।হেমন্তকে বলা হয় শীতের বাহন। প্রকৃতিতে অনুভূত হচ্ছে শীতের আমেজ। গ্রামীণ জনপদে এখন অনুভূত হচ্ছে হালকা শীতের আমেজ।
খালবিল থেকে সবে মাত্র বর্ষার জল শুকাতে শুরু করে। আকাশে মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়ায় নীল মেঘের ভেলা। কাঁশবনের শন শন শব্দ আর পাখ পাখালির কিচির মিচিরে জনপদ মুখর থাকে ।পরাণে তীব্র শীস দেয় কোন এক আকুলতা। গ্রামাঞ্চলে শুরু হয় মাছ ধরার উৎসব। বর্ষা আর শরতের বৃস্টির জলধারা হেমন্তে শুকাতে থাকে। মাছ ভাতে বাঙালি হেমন্তকালে জাল, বর্শা, পলো, লুই নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গ্রামের গেরস্থ কর্তা ঘরে ফেরে ডুলাভর্তি মাছ নিয়ে।
আর এ অনুভূত হয় সময়ে হালকা শীত । ধান উৎপাদনের ঋতু হচ্ছে হেমন্ত।অন্যদিকে বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন ও আউশ বেড়ে ওঠে শরতে । আর ধান পরিপক্ক হয় হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে এবং তখনই ধান কাটার উপযোগী হয়। আর এই হেমন্তে শুরু হয় কৃষকের ঘরে ফসল তোলার প্রস্তুতি। কাস্তে হাতে কৃষকরা মাঠে মাঠে আমন ধান কাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর নতুন ফসল দেখে কৃষকের মুখে ফুটে ওঠে হাসি।
হেমন্তে নবান্নকে ঘিরে উৎসব হয় বাংলার প্রত্যেক ঘরে ঘরে।হেমন্তের ফসল কাটাকে কেন্দ্র করেই নবান্ন উৎসবের সূচনা হয়, নবান্ন অর্থ-নব নতুন আর অন্ন হলো ভাত।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফসল তোলার সাথে সাথেই নতুন চালের ফিরনি-পায়েশ অথবা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে বিতরণ করা হয়। নবান্নে মেয়ে জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়, মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইওর’ আনা হয়। হেমন্তকে তাই উৎসবের ঋতু বললেও ভুল হবে না।
হেমন্তে ফোটে শিউলী, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, দেবকাঞ্চন, হিমঝুরি, ধারমার, রাজঅশোক প্রর্ভতি নানা ধরনের ফুল । হেমন্তের সকালে শিউলীর সৌরভ বাঙালির প্রাণে আনে উৎসবের মেজাজ।
হেমন্ত ম্লান, ধূসর, অস্পষ্ট, তাকে যত অনুভব করা যায় তাত দেখা যায় না; শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষার মতো হেমন্ত এমন তীব্র, প্রখর, উন্মোচিত নয়, বসন্তের মতো তার বর্ণ, গন্ধ, গরিমা নেই, হেমন্ত মৌন, শীতল, অন্তর্মূখী।
বিশ্বকবি রবি ঠাকুর তাইতো লিখেছেন- “হিমের রাতে” কবিতায় হেমন্তের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে লিখেছেন- “হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে/হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে/ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো/দীপালিকায় জ্বালাও আলো/জ্বালাও আলো/আপন আলো/সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে”।