যুদ্ধ বিগ্রহ প্রচীন কাল থেকেই চলে আসতেছে। যুদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু প্রাচীন কাল থেকে যুদ্ধে অস্ত্রে ব্যবহারের পরিবর্তন ধীরে ধীরে ঘটেছে। আমরা যদি লক্ষ করি আজ থকে মাত্র ১০০ বছর আগে বিশ্বে যে পরিমাণ গাছ ছিলো এখন সে পরিমান গাছ নেই। আবার অন্য দিকে দেখা যাচ্ছে অনেক জীবনধারার ধ্বংস হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে জীববৈচিত্র্যের। আমরা যুদ্ধের জন্য অত্যাধনিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছি। আবিষ্কৃত হয়েছে মানুষ হত্যার আধুনিক অস্ত্র। যে অস্ত্র শুধু মনবজীবন কেড়ে নেয়নি কেড়ে নিয়েছে আমাদের পরিবেশ।
মনে পরে সেই পাল তোলা নৌকার কথা যা কিছু দিন পরে হয়তো স্থান পাবে জাদুঘরে। পায়ে প্যাডেল মেরে ভ্যান আর রিক্সার সংখ্যাও কমছে দিন দিন। বিজ্ঞানের আবিষ্কার আমাদের মুগ্ধ করেছে ঠিকই কিন্তু আমরা ক’জনে জানি এই আবিষ্কারই আমাদের পরিবেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কার আমাদের সুফলের পাশাপাশি অনেক কুফলও বয়ে এনেছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে পারমাণবিক বোমার কথা । বোমা বিস্ফোরণে মানুষতো মারা যাচ্ছে একই সাথে আমাদের পরিবেশও ধ্বংস হচ্ছে।
মানব সভ্যতা গড়ে ওঠার পর থেকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ সংঘটিত হয়ে আসছে এবং এর ধারাবাহিকতা এখনো চলমান। যুদ্ধের ভয়াবহতায় প্রাণ হারায় অগণিত মানব সন্তান, বিধ্বস্ত হয় নগর জনপদ এবং ধ্বংস হয় পরিবেশ-প্রতিবেশ। প্রাচীন কালে যুদ্ধে অস্ত্রের ব্যবহার ছিল সীমিত।
সেসময় যুদ্ধাস্ত্র বলতে তলোয়ার, বর্শা, তীর-ধনুক, বল্লম, মিনজানিক (Catapult) ইত্যাদিকে বুঝাত। বর্তমানে যুদ্ধাস্ত্র ডিজিটাল, লেজার গাইডেড ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় এগুলোর ধ্বংসলীলার প্রভাব ব্যাপক ও দূরপ্রসারী। আধুনিক সামরিক অভিযানে যেসব বোমা ও গোলা-বারুদ ব্যবহৃত হয় তা পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর স্থায়ী প্রতিক্রিয়া সৃষ্ঠি করে এবং মানবজাতির অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানে পারমাণবিক বোমার বিষ্ফোরণ ঘটায়। এতে ১লাখ ৪০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। বোমাটি বিস্ফোরিত হওয়ার সাথে সাথে তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াস। মুহূর্তের মধ্যে মানুষ, পশু-পাখী, জীব-জন্তু ও বন-বৃক্ষ পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়, ৫১,৭৮৫টি ঘর-বাড়ীতে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে। আশে পাশের যে সব মানুষ জীবিত ছিলেন তারা লিউকোমিয়া ও ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। পরবর্তী সময়ে নাগাসাকি ও হিরোশিমায় যে সব শিশু জন্ম লাভ করে তাদের অধিকাংশই ছিল বিকলাঙ্গ। বোমা হামলার ৬৯ বছর পরও জাপানের আকাশে-বাতাসে পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তার প্রভাব দৃশ্যমান। আজও দেশে দেশে যুদ্ধাস্ত্রের বিভীষিকা মানুষকে তাড়া করে। ১ম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) ১,২৫,০০০ টন রাসায়নিক বোমা এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে ৯৬,০০০ টন বোমা নিক্ষিপ্ত হয়। একা ১ম বিশ্বযুদ্ধে ৯০ লাখ সেনা সদস্য ও ৭০ লাখ বেসামরিক নাগরিক মারা যায়। দীর্ঘ দিন ধরে পরিচালিত এ যুদ্ধে রাসায়নিক বোমার কারণে আবহাওয়া বিষাক্ত হয়ে উঠে, পানি দুষিত হয় এবং চাষাবাদ বিঘ্নিত হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে রাসায়নিক বোমার যত্রতত্র বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সে দেশের বহু এলাকায় কোন ফসল হয় না। ২৪ প্রজাতির পাখি ও ৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী জীব বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ যুদ্ধে মার্কিন সেনা বাহিনী ২ কোটি গ্যালন হারবিসাইডস স্প্রে করে বন-জঙ্গল পরিস্কারের জন্য। এতে মাটি দুষিত হয়ে চাষাবাদের অনুপোযোগী হয়ে পড়ে এবং পরিবেশের উপর এর প্রতিক্রিয়া এখনও বিদ্যমান। উপসাগরীয় যুদ্ধে যে পরিমাণ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয় তার প্রভাবে পরিবেশ এখনো ভারী হয়ে আছে। এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ শ্বাসযন্ত্র ও ফুসফুসের নানা জটিলতায় আক্রান্ত। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে বাধ্য হয়ে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছিল কিন্তু তিনি তাঁর অনুসারী সাহাবাদের রণক্ষেত্রে ন্যায়-নীতি (Ethics of War) অনুসরণের জোর তাগাদা দেন। তিনি ঘোষণা দেন রণক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের অশীতিপর বৃদ্ধ, নারী, শিশু ও ধর্মীয় উপসনালয়ে অবস্থানরত পুরোহিতদের হত্যা করা যাবে না। অকারণে বৃক্ষ কর্তন করা যাবে না। ক্ষেতের ফসল নষ্ট করা যাবে না। কোন স্থাপনা ধ্বংস করা যাবে না। কূপ অথবা প্রস্রবণ ধারার পানি বিনষ্ট করা যাবে না। মহানবী (সা.) এর এ নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়। কারণ এসব কর্মকাণ্ড পরিবেশকে বিপন্ন করে তোলে। আধুনিক কালে সমর প্রান্তরে মানাবাধিকার সাসপেন্ড হয়ে যায় আর আল্লাহর রাসূল প্রদত্ত মানবাধিকার ও ন্যায় নীতি স্বাভাবিক ও যুদ্ধাবস্থায়ও বহাল থাকে। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষদের যুদ্ধ পরিহার করে শান্তির পথ ধরতে হবে। অন্যথায় পৃথিবী নামক এ গ্রহ যুদ্ধের পৈশাচিকতায় মনুষ্য বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পড়বে। এই বিভাগে প্রকাশিত মতামতের জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে