মাত্র এক রাতেই যমুনা নিয়ে গেল শতাধিক বাড়িঘর
চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই প্রমত্তা যমুনা টাঙ্গাইলের ৪ উপজেলায় হানা দিয়ে নদী গর্ভে নিয়ে গেছে শতাধিক বাড়িঘর, রাস্তা, হাট, তাঁত ফ্যাক্টরি, স’মিল ও ফসলি জমি।
ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরুরিভাবে ফেলা জিওব্যাগও যমুনার ভয়াল থাবা থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে। যমুনার প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিতে মাএ এক রাতেই শতাধিক স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে।
জানা গেছে, টাঙ্গাইল সদর উপজেলা, নাগরপুর, কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলায় বর্ষার প্রথম থেকেই যমুনার ভাঙন শুরু হয়েছে।
যমুনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত ১ সপ্তাহ ধরে ভাঙন শুরু হলেও গত বুধবার থেকে ভাঙনের তীব্রতা ব্যপক হারে বেড়েছে।
বৃহস্পতিবার এক রাতেই শুধুমাত্র সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের ৩টি ওয়ার্ডের শতাধিক বাড়িঘর, তাঁত ফ্যাক্টরি, স’মিল এবং হাট যমুনার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
এ সময় ৩টি ইউনিয়ন পরিষদের সাথে বঙ্গবন্ধু সেতুর যোগাযোগের সংযোগের অসমাপ্ত শেখ হাসিনা সড়কের একাংশ যমুনার গর্ভে চলে গেছে।
মাহমুদ নগর ইউনিয়নের মাকরকোল, নয়াপাড়া, কেশবমাইঝাইল, বারবাড়িয়া, কুকুরিয়া, কাতুলী ইউনিয়নের দেওরগাছা, ইছাপাশা, রশিদপুর, চানপাশা, খোশালিয়া, নন্দপাশা, হুগড়া ইউনিয়নের মসপুর, চকগোপাল, বারবেলা ও কচুয়া।
কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়নের আলীপুর, ভৈরববাড়ী। নাগরপুর উপজেলার সলিমাবাদ ইউনিয়নের পাইকশা মাইঝাইল, খাস তেবাড়িয়া, খাস ঘুণি পাড়া, ভূতের মোড়, চর সলিমাবাদ, ভারড়া, ভারড়া ইউনিয়নের শাহজানি, পাঁচতারা, আগদিঘলীয়া। ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী ইউনিয়নের ভালকুটিয়া এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা অনেক বেশি।
সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের উত্তর চরপৌলী, হাটখোলা, দশখাদা, পানিকোড়া এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, চরপৌলী হাটখোলা সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড হাটখোলাটি রক্ষার জন্য জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে ৩০০মিটার এলাকা পর্যন্ত জিওব্যাগ ফেলে। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। জিওব্যাগগুলোও শেষ পর্যন্ত যমুনার তীব্র স্রোতে তলিয়ে ভাঙন শুরু হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বার বার জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।
টাঙ্গাইল সদর এবং কালিহাতী উপজেলার সীমান্ত এলাকা উত্তর চরপৌলী ও আলীপুর গ্রামের অংশে অসমাপ্ত শেখ হাসিনা সড়ক (নর্দান প্রজেক্ট) রক্ষার জন্য ১০০ মিটার এলাকায় ফেলা জিওব্যাগ তলিয়ে গিয়ে সৃষ্ট ভাঙনে সড়কটির প্রায় ৫০০-৬০০মিটার নদীগর্ভে চলে গেছে।
উত্তর চরপৌলী গ্রামের স্থানীয় নুরুল ইসলাম বলেন, দেড় একর জায়গায় তার একটা তাঁত ফ্যাক্টরি ছিল। ফ্যাক্টরিতে ৫০টি পাওয়ারলোম চালু অবস্থায় ছিল।
বৃহস্পতিবার রাতে ফ্যাক্টরিটি যমুনার ভাঙনের কবলে পড়ে। তিনি শ্রমিকদের নিয়ে ফ্যাক্টরির তাঁতগুলো কোনো রকমে ভাবে সরিয়ে নিতে পারলেও ঘরটি নদীর পেটে চলে গেছে।
হাটখোলা এলাকার গৃহবধূ মিনা আক্তার বলেন, তাদের ৬০ শতাংশের বসতবাড়ি ছিল। সাম্প্রতিক ভাঙনের শিকার হয়ে এখন মাএ ১২-১৩ শতাংশ ভূমির উপর একটি মাত্র ঘর টিকে আছে। ভাঙন অব্যাহত থাকলে সেটাও একদিন নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।
কবরস্থান পাড়ার আব্দুল গফুর মন্ডল ও আজিজ মন্ডল বলেন, বুধবার বিকেলে হঠাৎ করেই যমুনা বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রলয়ঙ্করী তাণ্ডব চালিয়ে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি বাড়িঘর নদীর পেটে চলে গেছে।
তারা পাশের হাটে বাজার সদাই করা অবস্থায় চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে দেখেন তাদের ঘরবাড়িও নেই। মুহূর্তের মধ্যে যমুনা গ্রাস করে নিয়েছে।
কাকুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ভাঙনের শিকার হয়ে তার ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
গত ৩-৪ দিনের ভাঙনে ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে বড় গ্রাম চরপৌলীর বহু স্থাপনা ও বাড়িঘর যমুনা গিলে খেয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙনরোধে বার বার জিওব্যাগ ফেললেও তা কোনো কাজে আসছে না। তারা সদর উপজেলার মাহমুদ নগর ইউনিয়নের গোলচত্তর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য দাবি জানান।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, টাঙ্গাইলের চরাঞ্চলের বিশাল এলাকা প্রতিবছরই যমুনার ভাঙনের শিকার হয়।
এই ভাঙনরোধে ৩ বছর আগে একটি স্থায়ী বাঁধের প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। দীর্ঘ তিন বছরেও প্রকল্পটি অনুমোদন না হওয়ায় কাজ করা কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।