প্লাস্টিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে।। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টন প্লাস্টিকের তৈরি পণ্য একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হচ্ছে যা বিভিন্ন খাল-বিল, নদী-নালা হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে।বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম ২০০২ সালে আইন করে পলিথিনের ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এই আইনের বাস্তবায়ন এখনও হয়নি। আমরা প্রতিনিয়তই বিভিন্নভাবে প্লাস্টিক ব্যবহার করছি এবং ব্যবহার শেষে ফেলে দিচ্ছি। প্লাস্টিক পচনশীল না হওয়ায় তা আমাদের পরিবেশের ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করছে।
বিভিন্ন খবরে আসে সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের কারনে সামুদ্রিক মাছ, কচ্ছপ বা সামুদ্রিক পাখি ও অন্যান্য জলজ প্রাণী প্লাস্টিক খেয়ে থাকে যার কারনে এক সময় সে মারা যায়। এছাড়াও দেখি মৃত প্রাণীদের পেট থেকে প্লাস্টিক বের হচ্ছে।এসব জলজ প্রাণীর মতাে যেসব প্রাণী স্থলে বসবাস করে তারাও প্লাস্টিকণা খেয়ে থাকে।সম্প্রতি এমনি এক খবরে দেখা যায় যে, একটা গরুর পেট থেকে ৫২ কেজি প্লাস্টিক বের করা হয়েছ। আবার সামুদ্রিক ছোট্ট একটি কচ্ছপের পেট থেকে ২৫০ টুকরো প্লাস্টিক বের করা হয়েছে।এরা সবাই অতিরিক্ত প্লাস্টিক খেয়ে ফেলার কারণে মারা গেছে। আমাদের একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া প্লাস্টিকের টুকরোগুলো সারাজীবনের জন্য সমুদ্রের প্রাণীদের অত্যাচার করে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল প্লাস্টিকের স্ট্র ব্যবহার বন্ধ করেছে। প্রথম অস্ট্রেলিয়ান রাজ্য হিসেবে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া প্লাস্টিকের স্ট্র এবং চামচ ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ফাস্টফুড কোম্পানিগুলোও পিছিয়ে নেই। স্টারবাকস ২০২০ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের স্ট্র বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে। ম্যাকডোনাল্ডস সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে তারা যুক্তরাজ্য এবং আয়ারল্যান্ডের রেস্টুরেন্টগুলোয় প্লাস্টিকের স্ট্র নিষিদ্ধ করবে। বন অ্যাপেটিট, আমেরিকান একটি খাবার কোম্পানি, গত মে মাসে স্ট্র বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। আলাস্কা এয়ারলাইন, এয়ারলাইন কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রথম, স্ট্র ব্যবহার বন্ধ করছে।
সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে ‘ওয়ান টাইম ইউজ’ প্লাস্টিক পণ্যের বিকল্প ব্যবহার শুরু করেছে।যেমন- ইতালি প্লাস্টিকের স্ট্র ব্যবহার বন্ধে অনেক চমৎকার একটি উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যালে, জিন্স এবং চশমার উদ্ভাবক ইতালি এবার পাস্তার তৈরি স্ট্র এরও উদ্ভাবক হিসেবে নিজের নাম লেখালো। ইতালির বেশ কিছু বার প্লাস্টিকের স্ট্র এর পরিবর্তে পাস্তার তৈরি স্ট্র ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছে।ইতালিতে একটি কোম্পানি রয়েছে যারা পাস্তার তৈরি স্ট্র বানাচ্ছে। কোম্পানিটির নাম স্ট্রুডলস।
তারা বলেন, এই স্ট্র এক ঘন্টা সময় ধরে টিকে থাকে এবং ব্যবহার শেষে ফেলে দিলে খুব সহজেই পরিবেশের সাথে মিশে যায়। তবে এই স্ট্র কেবলমাত্র ঠান্ডা পানীয় পানের ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য। পানীয় যত ঠান্ডা হবে স্ট্র তত বেশি সময় টিকে থাকবে। গরম পানীয় এর ক্ষেত্রে সাধারণত কেউ স্ট্র ব্যবহার করে না। তাই এই স্ট্র পুরো পৃথিবীজুড়েই ব্যবহার হওয়া সম্ভব।
স্ট্রুডলসের প্রতিষ্ঠাতা ম্যাক্সিম গেলম্যান বলেন, স্ট্রুডলস শুধুমাত্র একটি স্ট্র তৈরির কোম্পানি নয়, আরো অনেক বড় কিছু। ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমে এই কোম্পানি পৃথিবীতে অনেক বড় বড় প্রভাব ফেলবে, বিশেষ করে সেইসব মানুষের উপর যারা পরিবেশ সম্পর্কে একেবারেই সচেতন নয়।
থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের সুপারমার্কেটগুলোও প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে অনেক কার্যকরী একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তারা পলিথিনের ব্যাগের পরিবর্তে কলা পাতা ব্যবহার করছে পণ্য প্যাকেট করতে। থাইল্যান্ডের রিম্পিং সুপারমার্কেট সর্বপ্রথম কলা পাতার প্যাকেটের ছবি তাদের সোশ্যাল মিডিয়া পেজে দেয়। এর পরেই এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে।
এখন পর্যন্ত উৎপাদিত ৯ বিলিয়ন টন প্লাস্টিকের মধ্যে মাত্র ৯% প্লাস্টিক পুনঃব্যবহার করা হয়েছে। বাকি প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেয়া হয়েছে। সুপারমার্কেটে ব্যবহৃত পলিথিনের ব্যাগ এই বর্জ্যের অনেক বড় একটি অংশ।
জাতিসংঘের পরিবেশ সংস্থার মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে ভূমিতে, পরিবেশে এবং সমুদ্রে ১২ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য থাকবে। এই বর্জ্যের মধ্যে সিগারেটের টুকরো, প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিনের প্যাকেট এবং প্লাস্টিকের বিভিন্ন খাবারের প্যাকেটের (চিপস, বিস্কুট, চকলেট ইত্যাদি) পরিমানই সবচেয়ে বেশি থাকবে। পরিবেশের সবচেয়ে বড় একটি সমস্যার সমাধান হিসেবে সুপার মার্কেটগুলোর এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার।
জার্মানীর একটি ফার্ম প্লাস্টিকের প্লেটের বদলে কলাপাতার তৈরি প্লেট বিক্রি করছে মাত্র ৫০ সেন্টে। তবে ভারতে বহুযুগ ধরেই কলাপাতার প্লেট ব্যবহার হয়ে আসছে। এটি তাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিরই একটি অংশ। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এবং মন্দিরে তারা কলাপাতার প্লেটে খাবার খেয়ে থাকে।ভারতে যদিও এখনো সরকারিভাবে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়নি তবে ২০২২ সালের মধ্যে ভারত সরকার প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহার বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে।
আবার পেরুর কয়েকজন তরুণ উদ্যোক্তা “বায়ো প্ল্যান্ট” নামে নতুন একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তারা প্লাস্টিকের তৈরি প্লেটের বদলে কলাপাতার তৈরি প্লেট বাজারে নিয়ে এসেছে। এই প্লেট মাত্র দুই মাসের মধ্যে পুরোপুরি পরিবেশের সাথে মিশে যায়, যেখানে এক টুকরো প্লাস্টিক কমপক্ষে ৫০০ বছর সময় নেয়। ইনোভেট পেরু প্রোগ্রামের আর্থিক সহায়তার ফলে তারা মাসে ৫০,০০০ প্লেট তৈরি করতে পারছে।
এই প্রকল্পের প্রধান জোসে সোটো বলেন, এইসব প্লেট তৈরি করতে তাদের কলাগাছের পাতা কাটতে হয় না। কলার ছড়া কাটার সময় যেসব পাতা পরে যায় সেগুলো ব্যবহার করেই প্লেটগুলো তৈরি হচ্ছে।আমেরিকান দেশ হিসেবে পানামা একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। তারই পদনকশা ধরে গুয়েতেমালাও একই উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। তারা দেশের জনগণকে দুই বছর সময় দিচ্ছে এইসব পণ্যের বিকল্প খুঁজে নেয়ার জন্য।