পরিযায়ী বা অতিথি পাখির রহস্য জনক মৃত্যু
নতুন বছর এলো কিন্তু কাটলো না বিষ ও রহস্য। এবার আতঙ্ক পরিযায়ী বা অতিথি পাখিদের মৃত্যু ঘিরে! পক্ষীবিশেষজ্ঞ বনকর্মীদের কপালে এই তীব্র শীতেও চিন্তার ঘাম জমা হচ্ছে।
হিমাচল প্রদেশের পং বাঁধ সংলগ্ন জলাভূমি অঞ্চলে শত শত পরিযায়ী পাখির রহস্য মৃত্যু হচ্ছে। গত এক সপ্তাহেরও অধিক সময়ে এখানে মৃত পাখির সংখ্যা ১৭শত ছাড়িয়েছে। মৃত পাখিদের প্রজাতির তালিকায় রয়েছে বহু বিপন্ন প্রজাতির পাখিও। এখনও পর্যন্ত মৃত্যুর নির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা সম্ভব হয়নি। যার ফলে ক্রমেই বাড়ছে চিন্তা ও খুলছেনা রহস্যের জট।
১৯৭৬ সালে হিমাচল প্রদেশের নাগরোটা উপত্যকা অঞ্চলে এই জলাভূমিটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আই.ইউ.সি.এন তরফেও এই জলাভূমির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে।
প্রতি বছর বারহেডেড গিজ, ঢিল ইত্যাদি প্রজাতির পাখিরা ভালো সংখ্যায় আসে এখানে। এখানে রেড-নেক গ্রীবদেরও দেখা মেলে যা ভরতপুর অভয়ারণ্য ছাড়া ভারতে একমাত্র এই উপত্যকায়ই দেখা যায়।
প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর জুড়ে শীতকালে, প্রায় চার মাস অস্থায়ী ভাবে বসবাস করে পরিযায়ী পাখিরা। প্রধানত ১৮ হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে পরিযায়ীদের আনাগোনা চলে। সাইবেরিয়া এবং মঙ্গোলিয়া মূলত পাখিরা এখানে আসে। পরিযায়ী পাখিদের ইনডেক্স অনুযায়ী প্রায় ১.৫ লক্ষ পাখি এখানে আসে শীতকালে প্রতি বছর।
প্রায় ১১৪ টি প্রজাতির পাখি আসে এখানে । বিগত বছর অর্থাৎ ১৫ই ডিসেম্বর ২০২০-এর হিসেব অনুযায়ী, এর মধ্যেই এই বছর এসে পড়েছে ৫৭ হাজার পরিযায়ী পাখি। যার মধ্যে রয়েছে মরাল, কালো মাথার চিল, নদীচিল, তিলিহাঁসের মতো বিপন্ন প্রজাতির পাখি।
গত ২৮ শে ডিসেম্বর ওই অঞ্চলের ফতেপুর এলাকায় কয়েকটি পরিযায়ী পাখির মৃতদেহ নজরে আসে বনবিভাগের কর্মীদের। জলাভূমিতে প্রথমে ৩টি গিজ এবং ১টি ঢিলের মৃতদেহ পাওয়া যায়।
প্রথমে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি কিন্তু একদিনের মধ্যেই ওই জলাভূমি সংলগ্ন অঞ্চলেই ৪২৫ টি পাখির মৃতদেহ পাওয়া যায়। পরে ক্রমশই বাড়তে থাকে মৃত পাখির সংখ্যা। এর পরেই তাঁরা ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। অনুসন্ধান চলে! ‘ফরেস্ট ওয়াইল্ড লাইফ’ কর্তৃপক্ষ এই ঘটনার সত্যতাকে নিশ্চিত করেছেন।
এতো বিপুল সংখ্যায় পাখিগুলো মারা গেল কিন্তু কারণ পাওয়া যাচ্ছেনা কেন?
কারণে অনুসান করতে তদন্তেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি কবে প্রাথমিক পরীক্ষায় এটি নিশ্চিত করা হয়েছে যে পাখিগুলি কোনো রকম বিষক্রিয়ার কারণে মারা যায়নি বা খাবারে বিষ জাতীয় সমস্যাও হয়নি।
গিজের মৃত্যুর ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ঘটনা দেখা গিয়েছে, সব পাখি গুলোই মাটিকে পড়ে ছটফট করে মারা গিয়েছে। যা চিন্তাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে ! প্রশাসন তরফে পুরো এলাকা ঘিরে রাখা হয়েছে,পর্যটকদের ঐ অঞ্চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
কয়েকটি পাখির মৃতদেহ ভারতের নিম্নের এই চারটি পরীক্ষাগারে পরীক্ষার জন্যে নমুনা হিসেবে পাঠানো হয়েছে।
- জলন্ধরের ‘ইন্ডিয়ান ভেটেরিনারি রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ এবং ‘রিজিওনাল ডিজিজ ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরিতে নমুনা হিসেবে পাঠানো হয়েছে
- দেরাদুনের উত্তরপ্রদেশের বেরিলিতে ইন্ডিয়ান রিসার্চ ইনস্টিটিউটে নমুনা হিসেবে পাঠানো হয়েছে
- ভোপালের (HSADL) হাই সিকুরিটি অ্যানিম্যাল ডিজিজ ল্যাবরেটরিতে নমুনা হিসেবে পাঠানো হয়েছে
তাঁরা মৃতদেহের ময়না তদন্ত করে পাখি মৃত্যুর সঠিক কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করবেন। বাকি পাখিদের মৃতদেহগুলিকে দ্রুত পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। যার ফলে পাখিদের দেহে যদি কোনো রকম সংক্রমণ থেকেও থাকে, তা আর ছড়িয়ে পড়ার কোনো সম্ভবনাই থাকলো না।
ধামেটা ও নাগরোটা অরণ্য অঞ্চলের জাগমোলি ও গুগলাডা এলাকায় সর্বাধিক পাখি মৃত্যু হয়েছে। মৃত পাখিদের মধ্যে ৮৯ শতাংশই বারহেডেড গিজ প্রজাতির পাখি।
প্রতি বছর শীতের কারণে এই পরিযায়ী পাখিরদল সাইবেরিয়া ও মঙ্গোলিয়া থেকে আসে। অ্যাভিয়ান ফ্লু-কেও কারণ হিসেবে ভাবা হচ্ছে। যদিও সবই সম্ভবনা স্তরেই রয়েছে।
অন্যদিকে, রাজস্থানে বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যেই বহু পাখির মৃত্যু হয়েছে। কোটায় মারা পড়েছে ৪৭ টি কাক, ঝালাওয়ারে ১০০ টি কাক ও বারানে ৭২ টি কাক। যোধপুরে ১৫২ টি এবং জয়পুরে ১৩৫ টি কাকের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। কেবল কাক নয়, প্রচুর সংখ্যায় কিংফিসার এবং ম্যাগপাইও মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে যার সংখ্যা অগনিত।
মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরেও একই ঘটনাই প্রতক্ষ করা গেছে। ৫০ টি মৃত কাকের পরীক্ষা করা হয় ভোপালে,তাদের দেহে H5N8 ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে। গুজরাটের জুনাগড়ে ৫৩টি পাখির মৃত্যু হয়েছে। বার্ড ফ্লু ভাইরাসের আক্রমণের খবর আসার সঙ্গে সঙ্গেই কেন্দ্রের তরফে দেশের সমস্ত রাজ্যে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। যেখানে বার্ড ফ্লু জনিত কারণে পাখি মৃত্যু হয়েছে সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে।
একে কভিড-১৯ নামক অতিমারী চলছেই, তার মধ্যে এই নতুন উপদ্রব। সবচেয়ে মারাত্মক হলো এমন এক রোগ যার কারণ জানা যাচ্ছে না। বনকর্মী,পক্ষীবিদ, পরিবেশ কর্মী এবং সাধারণ পাখিপ্রেমীরা সকলেই উদ্বিগ্ন ! জীব বৈচিত্রের ক্ষতি হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদের এই ক্ষতি, ক্ষতি ডেকে আনছে পরিণবেশেরও। লুপ্ত প্রায় বিপন্ন প্রজাতির পাখি মৃত্যু ভয়ঙ্কর সম্ভবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।