পরিবেশবান্ধব সৌরবিদ্যুত ব্যবহারের মাধ্যমে পাল্টে গেছে বগুড়ার কৃষিচিত্র । অল্প খরচে সৌরবিদ্যুচ্চালিত শতাধিক পাম্পের মাধ্যমে জেলার লাখো কৃষক প্রায় ২০ হাজার বিঘা জমিতে ইরি, বোরো, আমন ছাড়াও শাকসবজি ও আলু চাষ করছেন।কৃষকেরা বলছেন, পরিবেশবান্ধব সৌরবিদ্যুচ্চালিত সেচপাম্পে চাষাবাদ করে খরচ ও সময় দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে। হয়রানি থেকেও মিলেছে মুক্তি।
জানা যায়, বগুড়া জেলার সোনাতলা ও শিবগঞ্জ উপজেলায় সৌরবিদ্যুচ্চালিত ৬৫টি সেচপাম্প চালুর মাধ্যমে ১৩ হাজার বিঘা জমিতে সেচসুবিধা দিচ্ছে সালেক সোলার পাওয়ার লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সরকার এবং জার্মান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশনের অর্থায়নে এ কাজে সহযোগিতা করছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডে (ইডকল)।
ইডকলের কর্মকর্তারা বলছেন, আমন, বোরো ও রবি তিন ফসলেই সৌরশক্তি ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ পানি ওঠানো হচ্ছে। তবে কৃষকেরা সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছেন বোরো মৌসুমে। ওই সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় জাতীয় গ্রিডে চাপ থাকে। ফলে লোডশেডিং হওয়ায় সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হয়। আবার বোরো মৌসুমে সেচযন্ত্র চালাতে গিয়ে ডিজেলের সংকটেও পড়তে হয় কৃষকদের। সৌরবিদ্যুচ্চালিত সেচ কার্যক্রমে এসব ভোগান্তির বালাই নেই। ডিজেলচালিত পাম্পে সেচ খরচ গুনতে হয় কৃষকদের প্রতি বিঘায় গড়ে চার হাজার টাকা। আর সৌরবিদ্যুচ্চালিত পাম্পে সেচ খরচ হয় বিঘায় গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিজেলচালিত শ্যালোমেশিনে সেচ দেওয়ার জন্য মেশিনের মালিকদের কাছে ধরনা দিতে হয়। সঠিক সময়ে পানি মেলে না। সৌরবিদ্যুচ্চালিত পাম্পে এসব সমস্যা নেই। এ প্রযুক্তি দিয়ে দিনে টানা আট ঘণ্টা পানি ওঠানো সম্ভব। প্রতিটি সোলার পাম্প থেকে দিনে ৩০ লাখ লিটার পানি ওঠে।
ইডকলের ভাইস প্রেসিডেন্ট (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) নাজমুল হক ফয়সালকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ইডকল এ পর্যন্ত ১ হাজার ২৮৮টি সৌরবিদ্যুচ্চালিত সেচপাম্প স্থাপন করে কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এসব সেচপাম্পের ৬৫ শতাংশই উত্তরাঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ২ লাখ ৫৭ হাজার বিঘা জমি সেচসুবিধার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে বগুড়ায় স্থাপন করা হয়েছে সৌরবিদ্যুৎ–নির্ভর পরিবেশবান্ধব ৬৫টি নলকূপ। প্রতিটি ২০ থেকে ৩০ হর্স পাওয়ারের সেচপাম্প স্থাপনে খরচ পড়ে গড়ে ৬২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ইডকল অর্ধেক টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। অবশিষ্ট অর্থের ৩৫ শতাংশ উদ্যোক্তাদের ঋণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি সোনাতলা উপজেলার উত্তর কালাইহাটা, অড়িয়ার ঘাট, ভেলুরপাড়া, বালুয়াহাট, সিচারের পাড়া, কাচারিবাজার, হরিখালী, পদ্মপাড়া এবং শিবগঞ্জ উপজেলার গুজিয়া, শ্যামপুর, তালুকপুর, মজুমদার ও শিবতলা মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, ৪২ কিলোওয়াট শক্তির সৌর প্যানেল এবং ৩০ হর্স পাওয়ারের ৬৫টি পাম্প স্থাপন করেছে সালেক সোলার পাওয়ার লিমিটেড। সৌরবিদ্যুচ্চালিত সেচসুবিধায় বদলে গেছে কৃষির চিত্র।
বালুয়াহাটের কৃষক আজহার আলী বলেন, এ মাঠে ২০০ বিঘা জমিতে সেচ দিতে একসময় ডিজেলচালিত ছয়টি শ্যালোমেশিন চলত। বোরো মৌসুমে সেচ দিতে গিয়ে সেচপাম্পের মালিকদের হিমশিম খেতে হতো। কখনো ডিজেলের সংকট, কখনো ইঞ্জিন বিকল হতো। সেচ বিঘ্নিত হওয়ায় ধান চিটা হতো। এখন সৌরবিদ্যুচ্চালিত একটি সেচপাম্পের আওতায় এসেছে পুরো মাঠ। এই পাম্পে পানি বেশি ওঠায় খেতে সেচ দিতে বেশি সময় লাগে না। খরচও অর্ধেক। খেতে পর্যাপ্ত পানি থাকায় ফলনও বেড়েছে দেড় গুণ।
উপজেলার উত্তর কালাইহাটের কৃষক জহর আলী বলেন, ‘এ মাঠে ১০ বিঘা জমি রয়েছে। তিন বছর আগেও ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে মোটর পুড়ে যেত, ঠিকমতো সেচ দেওয়া যেত না। সৌরবিদ্যুচ্চালিত নলকূপ স্থাপনের পর সেখান থেকে সেচ দিচ্ছি। এতে খরচ কম। পাশাপাশি অন্য কোনো ঝামেলা নেই।
এ বিষয়ে সালেক সোলার পাওয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালেক উদ্দিন বলেন, কৃষি ও কৃষককে সেচ সহায়তা দিতে ইডকলের সহায়তায় তিনি বগুড়ায় ৬৫টি এবং গাইবান্ধার সাঘাটায় ৫টি সৌরবিদ্যুচ্চালিত গভীর নলকূপ স্থাপন করেছেন। সেচের খরচ কম হওয়ায় কৃষকেরা সৌরবিদ্যুচ্চালিত সেচপাম্পের ওপর ঝুঁকছেন। উৎপাদন খরচ কমে যাওয়ায় কৃষকেরা লাভের মুখ দেখছেন। প্রতিটি পাম্পে খরচ হয়েছে গড়ে ৬২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ পুঁজি তিনি নিজে থেকে বিনিয়োগ করেছেন। বাকিটা দিয়েছে ইডকল।
যমুনার দুর্গম চরেও সৌরবিদ্যুতের রোশনাই
বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলে রাতের অন্ধকারে কেরোসিনের কুপি আর হারিকেনের বদলে সেখানে এখন ঘরে ঘরে জ্বলছে সৌরবিদ্যুতের বাতি। চলছে টেলিভিশন, কম্পিউটার, চার্জ দেওয়া যাচ্ছে মুঠোফোন, অটোরিকশা। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছে সৌরবিদ্যুতের আলোয়। ইন্টারনেট–সুবিধা মিলছে সৌরবিদ্যুতের কারণে। হাটে, মাঠে, রাস্তাঘাটে জ্বলছে সড়কবাতি। সৌরবিদ্যুচ্চালিত গভীর নলকূপ থেকে উঠছে পানি। ছোট-বড় সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেই সোলার বাতির ব্যবহার হচ্ছে।
সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাসেল মিয়া বলেন, সৌরবিদ্যুতের ছোঁয়ায় পাল্টে গেছে যমুনার দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবন। সৌরবিদ্যুতের আলো ছড়িয়ে পড়েছে প্রায় ১৫টি দুর্গম চরে। ফ্যান চলছে, টেলিভিশন চলছে। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সেবাও মিলছে। মুঠোফোনে চার্জ দেওয়া যাচ্ছে। বৈদ্যুতিক পাম্পে খাবার পানি মিলছে। সেচসুবিধা নিশ্চিত হওয়ার কারণে কৃষিতেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।