মায়ের স্তন্যপান নবজাতকের অধিকার; কোন মা বাবা সন্তানের এই অধিকার হরণ করতে পারেন না
জন্মের সময়ই নারী জাতীর ক্ষেত্রে স্রষ্টা তার দেহে ভবিষ্যৎ সন্তানের স্তন্যপান করানোর জন্য অবকাঠামো গড়ে দিচ্ছেন । কোন নারী যখন সন্তান সম্ভাবনা হন, তার দেহের ভিতর সন্তান বড় হওয়ার সাথে সাথে সন্তান যাতে পৃথিবীতে এসেই তাঁর সহজ ও উপযুক্ত খাদ্য পায় সে জন্য স্রষ্টা তার মায়ের বুকে তার জন্য দুগ্ধ সৃষ্টি করে দেন ।
সুতরাং এই দুগ্ধ একান্তই তার – কোন মা বাবা তার নবজাতক সন্তানের এ অধিকার হতে তাকে বঞ্চিত করতে পারেন না । এখানে মায়ের সাথে বাবার বিষয়টি টেনে আনলাম এই জন্য যে, কিছু মা যেমন মনে করেন সন্তানকে বুকের দুগ্ধ পান করালে শরীরের গঠন নষ্ট হতে পারে, বুকের সৌন্দর্য হারিয়ে স্বামীর সোহাগ হতে বঞ্চিত হতে পারেন, আবার কোন কোন স্বামীরও এ রকম অদ্ভুত চিন্তা রয়েছে ।
আসলে বিষয়টি একেবারেই আজগুবি এবং বাস্তব সম্মত নয় । শিশুর মায়ের দুগ্ধ পান শেষ হলেই বুকের গঠন ঠিক অন্যান্য অঙ্গের ন্যয় পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায় । মূলত নারীর গঠন নষ্ট হয় অযত্নে, অবহেলায় ও অলসতায়, নিয়মিত ব্যায়াম না করা, উপযুক্ত মাপেরর অন্তর্বাস পরিধান না করা এবং নিয়মানুযায়ী না পরা।
আমরা বড়দের যখনই ক্ষুধা লাগে তখনই খাই, হয় সেটা পড়া লেখার টেবিলে, অফিসে, মাঠে ঘাটে, হাটতে, চলতে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে; অথচ যে শিশু তার বয়স একদিন বা এক বছর হউক না কেন- ক্ষুধা লাগলে যে ক্ষুধার কথা বলতে পর্যন্ত পারছে না ।
এ বিশাল পৃথিবীতে বড়দের সর্বত্র খাওয়ার অধিকার থাকলেও তার সে অধিকার নাই, সে বড়দের মতো যত্রতত্র সে তার মায়ের দুগ্ধ পান করতে পারছে না, তার খাওয়ার স্থান খুবই সংকুচিত ।
বড়ই বিচিত্র এই পৃথিবী! শিশুদেরকে উন্মুক্ত স্থানে দুগ্ধ পানেও রয়েছে বিচিত্রতা । আমাদের মত পশ্চাৎপদ সমাজের কথা বাদ দিলেও উন্নত বিশ্বেও মা তার সন্তানকে উন্মুক্ত স্থানে দুগ্ধ পান করাতে পারছে না ।
যেখানে কম বয়সী মেয়েরা সী-বিচে বিকিনি পড়ে ঘুর বেড়ায় এবং জনসমাগম স্থানে আঁটসাঁট পোশাক পরিধান করে বা স্বল্প কাপড় পরে বা খোলামেলা ঘুরে বেড়ায় সেখানেও মায়েরা উন্মুক্ত স্থানে তাদের সন্তানদেরকে বুকের দুধ পান করাতে পারেন না বা করতে লজ্জা বোধ করেন ।
কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া মেক্সিকোর এমনি একটা ঘটনার কথা বলা যাক । ২০১৪ সালে দেশটির স্তন্যপান করানোর হার সারা লাতিন আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে কম ছিল, ১৪ শতাংশ মায়েরা তাদের নবজাতক শিশুকে প্রথম ৬ মাস বুকের দুধ খাওয়াতেন এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা ৩০ শতাংশ হয়েছে, যা কিনা বৈশ্বিক গড় হার ৪১ শতাংশেরও নিচে ।
২০১৫ সালে, দেশটি বিনামূল্যে হাসপাতালে সন্তান দান করাকে নিষিদ্ধ করেছে, যাতে করে স্তন্যপান করানোর হারটি বর্ধিত হয় । কিন্তু হায়, তবুও জনসম্মুখে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো নারীকে সহ্য করা যায় না !
৩ সন্তানের জননী মেলানি ডাডলি, ছুটির সময় ক্যাবসান লুকাস, মেক্সিকোতে রেল স্টেশনের একটি রেস্টুরেন্টে তার শিশুকে স্তন্যপান করাচ্ছিলেন, তখন একজন লোক তার সামনে এসে বলেন যে, স্তন্যপান ঢেকে রেখে করান ।
বহিরাগত লোকটির কথা বিবেচনা করে সে ঢাকার জন্য কিছু দিতে তার স্বামীকে বলে । তখন সে একটি অন্যরকম উপায়ে ঢেকে ফেলেছিলেন, অর্থাৎ স্তন্যপান না ঢেকে তার মাথাকে কম্বল দ্বারা আবৃত করে বাচ্চাকে পরিচর্যা করতে থাকেন ।
সেই মুহূর্তে তার স্বামী একটি অমূল্য ছবি তুলে তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয় । তিনি এটি ফেসবুক পোস্ট করেন । এটি ফেসবুকে আপলোড হওয়ার পর পরই ভাইরাল হয়ে যায় এবং তার অনুভূতিকে অনেকেই সমর্থন জানিয়ে মন্তব্য লিখেন যে, তার বাচ্চা যখন ক্ষুধার্ত তখন তার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোতে লজ্জা পাওয়ার বা দোষের কোন কারণ নেই ।
ছবিটিতে ১,৩৮,০০০ টি প্রতিক্রিয়া, ৪০,০০০ টি মন্তব্য এবং ২,২৬,০০০ শেয়ার হয়েছে । মানুষ মন্তব্য করে যে তারা বুঝতে পারে না আজকের উন্নত সমাজে সব ধরনের নগ্নতা কিভাবে গ্রহণযোগ্য! কিন্তু যখন স্তন তার প্রাকৃতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় তখন আমরা বিব্রত বোধ করি।
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের ফেডারেল সেন্টার গুলোর মতে, বুকের দুধ শিশুদের জন্য পুষ্টির একমাত্র সেরা উৎস এবং বুকের দুধ মা এবং শিশুর স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ টি রাজ্যে জনসম্মুখে স্তন্যপান বৈধ করা হয়, কিন্তু মায়েরা এখনও লজ্জা পাচ্ছেন বা মানুষ এখনও এটিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি ।
দেখা যাচ্ছে, এটাকে প্রাকৃতিক প্রয়োজনীয়তা হিসেবে গ্রহণ করবার জন্য মানুষের আরও সময় প্রয়োজন। অনেক মাকে রেস্টুরেন্টের বাথরুমে তাদের সন্তানদের খাওয়াতে বলা হয়। যেটা সত্যিই ভয়ানক !
এছাড়াও, যদি যে কোনো ধরনের ফ্যাশনেবল এবং অত্যন্ত খোলামেলা পোশাক নিষিদ্ধ না হয় এবং রুচি-পূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়, তবে স্তন্যপান করানো কিভাবে অনুপযুক্ত হতে পারে ? ডাডলি আরও বলেন যে, তিনি জানেন যে তার ছবিতে কিছু নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে, কিন্তু এটি জনসম্মুখে স্তন্যপান করাতে পছন্দ করা মায়েদের জন্য একটি ছন্দময় গতি এনে দিয়েছে । তিনি বলেন যে, বুকের দুধ খাওয়ানো যথেষ্ট কঠিন কাজ, তাই এটি কিছু মায়ের আমলে আনার দরকার নেই ।
আপনি কি কখনো প্রাপ্তবয়স্কদের জনসম্মুখে খেতে বিব্রত হতে দেখেছেন? তাহলে কীভাবে আমরা মায়েদের তাদের শিশুদের খাওয়ানোর জন্য দোষারোপ করতে পারি?
ধর্মীয় এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে, আমাদের দেশের মায়েদের জন্য প্রকাশ্যে তাদের সন্তানদের বুকের দুধ খাওয়ানো জায়েয নয়। যাইহোক, যেখানে প্রাপ্তবয়স্করা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে, হেঁটে তাদের ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে, সেজন্য অফিস- আদালতে, মিল- কারখানায়, পার্ক, রেস্টুরেন্ট, বাজার, রাস্তার মোড়, রেলওয়ে স্টেশন এবং বাস ও লঞ্চ স্টেশনে এমন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে- যাতে মায়েরা তাদের শিশুদের নিরাপদে এবং গোপনে স্তন্যপান করাতে পারেন।
তবেই জনগণের মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়টি যেমন গুরুত্ব বাড়াবে এবং স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করা হবে, তেমনি দেশটিতে শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানোর শতকরা হার বৃদ্ধিতে একটি বিপ্লব ঘটবে দেশ পাবে সুস্থ ও বলিষ্ঠ নাগরিক, কমবে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার ।
বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন অফিস – আদালতে “শিশু যত্ন কেন্দ্র স্থাপন” এর উদ্যোগ নিয়েছে । বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ৪৬ – ৫০ ধারায় মা ও শিশুর যত্নের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে । উক্ত ধারায় চাকুরীজীবী মহিলাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস করা হয়েছে ।
২০১২ সাল থেকে বেসরকারি খাতে কর্মরত মায়েদেরও এই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। যদিও এই আইন এখনো সর্বাত্মকভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
তৎপ্রেক্ষিতে সকল অফিস- আদালতে, কলকারখানায় “মাতৃ দুগ্ধ পান কর্নার” স্থাপনে ৬০ দিনের সময় দিয়ে বাংলাদেশ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে বাংলাদেশের মহামান্য হাই কোর্ট একটি আদেশ জারী করেছে ।
আসুন আমরা সারা বিশ্বে মায়েদের বুকের দুধ খাওয়ানোকে একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে গ্রহণ করি, সহযোগিতা করি এবং দায়িত্ব বোধ করি ।
Ref: Patch