দুর্যোগ মোকাবিলায় ১২ সুপারিশ, আত্মতুষ্টির সময় আসেনি: টিআইবি
দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা ও প্রস্তুতির যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও এখনও আত্মতুষ্টির সময় আসেনি বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তবে বিদ্যমান সুশাসনের ঘাটতি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বারো দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
২৪ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি উপস্থাপন করা হয় সংস্থাটির পক্ষ থেকে। সংবাদ সম্মেলনে ‘দুর্যোগ মোকাবেলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়: ঘূর্ণিঝড় আমফানসহ তার পরবর্তী অন্যান্য ঘূর্ণিঝড় বিষয়ক সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রাণহানি কমানো, দুর্যোগ মোকাবিলার একটি কাঠামোবদ্ধ মডেল প্রস্তুত করার সাথে সাথে তা অনেক দেশ কর্তৃক অনুসরণসহ বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবিলায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। তবে এখনো যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধন, ও পদ্ধতিগত উন্নয়নের সুযোগ আছে এবং এখনই আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই।
কারণ, ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বিদ্যমান সুশাসনের যথেষ্ঠ ঘাটতি আছে। যার কারণে এখনো বছরে জাতীয় আয়ের প্রায় ২.২শতাংশ ক্ষতি হয়। এসব ঘাটতি নিরসন করা গেলে দেশের জাতীয় আয়ের বিশাল ক্ষতি ঠেকানো বা কমানো সম্ভব।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন ইউনিটের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. নেওয়াজুল মওলা এবং জলবায়ু অর্থায়নে পলিসি ইন্টিগ্রিটি প্রজেক্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার কাজী আবু সালেহ।
ঘূর্ণিঝড় আমফানসহ সাম্প্রতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সুশাসনের অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জসমূহ পর্যালোচনা করতে গত ১৮ মে – ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্রায় ৭ মাস গবেষণার তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন প্রণয়নের কাজ করা হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, সেনডাই ফ্রেমওয়ার্ক ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তিসহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার এবং দুর্যোগ বিষয়ক জাতীয় আইন, নীতি এবং আদেশাবলী প্রতিপালনে ঘাটতি রয়েছে।
সুন্দরবনসহ পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ স্থাপন, দুর্যোগে ক্ষয়-ক্ষতি’র সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ এবং ক্ষয়-ক্ষতির প্রতিবেদন প্রণয়ন ও প্রকাশে ঘাটতি, আন্তর্জাতিক উৎস হতে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহে সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। তবে দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যবসাভিত্তিক ‘বীমা ও বন্ড’ ব্যবস্থার প্রতি নির্ভরতা বেড়েছে।
সতর্কবার্তা ঝুঁকিপূর্ণ জনসাধারণের বোধগম্য না করতে পারাসহ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে দুর্যোগ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশে কাঠামোবদ্ধ নির্দেশিকা যেমন নেই তেমনি দুর্যোগ প্রস্তুতি, সাড়াদান ও পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম সংক্রান্ত তথ্য উন্মুক্তকরণে (প্রকাশ ও প্রচার) ঘাটতিও রয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২, জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০১৫, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণ নীতিমালা-২০১১, দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলী ২০১৯ সহ সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধানে উল্লেখিত সুনির্দিষ্ট নির্দেশাবলী প্রতিপালনে ব্যত্যয় হয়েছে।
গবেষণায় ফলাফল ও তথ্য বিশ্লেষণ করে, দুর্যোগ মোকাবিলায় টিআইবি ১২ দফা সুপারিশ করেছে। সুপারিশগুলো মধ্যে রয়েছে:
- ১. বিদ্যমান সতর্কবার্তা প্রদানের যে পদ্ধতি আছে তা হালনাগাদ করে সাধারণ জনগণের বোধগম্য সহজ ভাষায় প্রচার করা।
- ২. অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলসমূহকে ক্রমবিন্যাস করে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে যথাসময়ে পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা প্রদানের ব্যবস্থা করা।
- ৩. অধিকতর বিপদাপন্ন পরিবার ও এলাকাকে প্রাধান্য দিয়ে ত্রাণ, পুনর্বাসন সহ সকল মৌলিক অধিকার কার্যক্রম স্বচ্ছতার সাথে পরিচালনা করা।
- ৪. ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত তথ্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে তথ্য জনগণের জন্য যথাযথ ভাবে উন্মুক্ত করা।
- ৫. আপদকালীন পরিস্থিতি ও দুর্যোগের সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ের কয়েকটি কমিটি, স্বেচ্ছাসেবক দল ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের কার্যকর অংশগ্রহণে দুর্যোগ প্রস্তুতি গ্রহণ করা ও দুর্যোগ পরর্বতী পদক্ষেপ সম্পর্কে আগাম পরিকল্পনা গ্রহন।
- ৬. নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ সুবিধা সম্বলিত এবং এলাকা ভিত্তিক প্রয়োজনমত আশ্রয়কেন্দ্র নিশ্চিত করা।
- ৭. আশ্রয় প্রার্থীদের সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পরিমানমত প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানি, পয়ঃনিস্কাশন, জরুরি চিকিৎসা সেবার সারঞ্জম বিষয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ এবং তা সরবরাহ নিশ্চিত করা।
- ৮. স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে ‘অংশগ্রহণমূলক’ পদ্ধতিতে দুর্যোগ সহনশীল এবং টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ, সংস্কার ও পুনঃনির্মাণ করা।
- ৯. প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতাসহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কার্যক্রমে কোনপ্রকার দুর্নীতি, অনিয়ম এবং অপচয় থাকলে সেটি বন্ধে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা।
- ১০. প্রকাশিত অনিয়ম-দুর্নীতির স্বচ্ছ তদন্ত ও দোষী প্রমানের পরবর্তীতে দোষীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।
- ১১. দুর্যোগের ফলে বাস্তুচ্যূত পরিবারগুলোর জীবিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নতুন জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় তাদের সক্ষমতা তৈরিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা।
- ১২. দুর্যোগ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বিশেষ করে নেদারল্যান্ডের মতো দেশের পানি ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে উপকূলীয় অঞ্চলকে সুরক্ষার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা।
সূত্র:আরটিভি নিউজ