বুড়িগঙ্গা নদীতে বসানো সীমানা পিলারগুলি ভুল এবং আবার বিতর্কের সৃষ্টি
বুড়িগঙ্গা নদীর সীমানার অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশে বসানো সীমানা পিলারগুলি ভুল জায়গায় বলে প্রতিবেদনে দাবি করছে আরডিআরসি
আদালতের আদেশে ঢাকার চার পাশের নদীতে সীমানা খুঁটি শুধরে পুনঃস্থাপনের পর তা নিয়েও উঠেছে বিতর্ক। এবারও সীমানা খুঁটি ‘ভুল’ স্থানে বসানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে; তবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) দাবি করছে, ‘নির্ভুলভাবেই’ তা বসানো হয়েছে।
হাই কোর্টের আদেশে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদী দখল ঠেকাতে নদী টাস্কফোর্সের পরামর্শে ২০১১ সালে বিআইডব্লিউটিএ থেকে সীমান্ত খুঁটি স্থাপনের কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু মাত্র ছয় হাজার আটশো তিতাল্লিশটি সীমানা পিলারের মধ্যে চার হাজার তেষট্টিটি বসানোর পর তার প্রায় এক হাজারটি সঠিক স্থানে প্রতিস্থাপন না করলে কাজ স্থগিত রাখা হয়।
এরপর হাই কোর্টের আদেশে জরিপ চালানোর পর বিআইডব্লিউটিএ ‘বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরভূমিতে পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় মোট দশ হাজার ৮২০টি সীমানা পিলার বসানোর কাজ চালাচ্ছে। এজন্য আটশো আটচল্লিশ কোটি পঞ্চান্ন লাখ টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
তবে এবারও ভুল স্থানে সীমানা খুঁটি বসেছে বলে দাবি করেছে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) নামে একটি সংস্থা।
সম্প্রতি বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদী সরেজমিনে ঘুরে তারা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ খুঁটি ‘ভুল জায়গায়’ বসানো হয়েছে।
বুড়িগঙ্গা নদীতে এই অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশে বসানো পিলারটি ভুল জায়গায় বলে প্রতিবেদনে দাবি করছে আরডিআরসি বুড়িগঙ্গা নদীতে এই অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশে বসানো পিলারটিও ভুল জায়গায় বলে প্রতিবেদনে দাবি করছে আরডিআরসি,
আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, “তিন হাজার ৮৪টি পিলার জরিপ করে এক হাজার চারশো তেইশটি পিলার আমরা একেবারে পানির মধ্যেই পেয়েছি।”
তবে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন) কাজী ওয়াকিল নওয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি তো (সীমানা পিলার বসানো) শতভাগ নির্ভুল বলেই মনে করছি।”
এদিকে আরডিআরসির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত বছরের পনেরো থেকে সতেরো অক্টোবর তারা সরেজমিন পরিদর্শন করে ‘ভুল’ সীমানা খুঁটি দেখতে পান।
এজাজ বলেন, “আমরা যখন মাঠে গিয়েছি তখন নদীর পানির লেভেল প্রায় পাঁচ ফুট কম ছিল, এরপরও পিলারগুলো নদীতে পেয়েছি আমরা।”
তিনি আরো বলেন, “ফিল্ডে গিয়ে আমাদের মনে হয়েছে ফোরশোর ম্যাপটা অনুসরণ করা হয়নি, যেটা ওয়াটার মার্ক ধরে করতে হবে।”
বাংলাদেশ পানি আইনে বছরের যে কোনো সময় ভরাটকাল চলাকালীন নদীর সর্বনিম্ন পানি স্তর হতে সর্বোচ্চ পানি স্তরকে নদীর ঢাল বা নদীর তীরভূমি বা ফোরশোর বলা হয়েছে।
বন্দর আইন-১৯০৮ অনুযায়ী ঘোষিত নদী বন্দর ও সমুদ্র বন্দর এলাকায় সর্বোচ্চ পানি স্তর হতে পঞ্চাশ মিটার এবং অন্যান্য এলাকায় সর্বোচ্চ পানি স্তর হতে দশ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা নদীর তীর।
সীমানাখুঁটি বসানোর পদ্ধতি নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, “পোর্ট লিমিট (বন্দর সীমা) বরাবর পিলার বসানো হচ্ছে।
“এখানে কঠিন কোনো টেকনিক দরকার হয় না। অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ দিয়ে ফোরশোর ধরে ১০০ ফুট পর পর পিলার বসানো হচ্ছে।” পিলারের জায়গা নির্ধারণে প্লাবন ভূমি ও নদী এক করে ফেলার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন বিআইডব্লিউটিএ পরিচালক কাজী নওয়াজ।
ফোরশোরের অন্তর্ভুক্ত নয় বলে প্লাবনভূমিতে নদীর সীমানাখুঁটি বসানোর এখতিয়ার তাদের নেই বলেও জানায় বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ।
নদীর সীমায় ৩৫% খুঁটি ভুল জায়গায়, ‘নদীর ত্রুটিপূর্ণ সীমানা পিলার সরিয়ে ফেলা হবে’ , তুরাগ ও বালু নদীর সীমানা নির্ধারণের নির্দেশ
এদিকে নদীর সীমানা খুঁটি বসানোতে ত্রুটি দেখতে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের বিদায়ী চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদারও।
তিনি বলেন, “আমি নবাবের চর, কামরাঙ্গিরচর, ওয়াশপুর এবং তুরাগে গিয়ে দেখে এসেছি। ওখানে একাধিক অফিসার ছিলেন। আমি কিন্তু সবার সামনে প্রশ্ন করেছি, এটা তো (সীমানা পিলার) আরও উপরে যাবে, এত নিচে কেন দিলেন? একেক জায়গায় একেক রকম হয়েছে… এটার সদুত্তর কিন্তু তারা দিতে পারেনি।
“সিএসের ভিত্তিতে আরএসের সাথে তুলনা করে দেখতে হবে। সিএসে নদী থাকলে আরএসে কোথায় গেল নদীটা? ব্যক্তির কাছে গেল কি না? যদি যায়, সেটা ভুল হয়েছে; সেটাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে।”
সিএস (ব্রিটিশ আমলে চালানো ভূমি জরিপ) ও আরএস (হালনাগাদ ভূমি জরিপ) খতিয়ান অনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারণের কাজটি জটিল বলে মনে করেন পানি বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত।
সম্প্রতি ‘ঢাকার চার নদীর সীমানা পিলার’ শিরোনামে এক ফেইসবুক লাইভে যোগ দিয়ে তিনি বলেন, “নদীটা তো ফিক্সড না … কেউ বলে আমার যেখানে নদী ছিল সেখান থেকে নদী ২০ ফুট, ৩০ ফুট, ৫০ ফুট, ১০০ ফুট দূরে চলে গেছে।
“এখন যেটা ডাঙ্গা, সিএস-আরএস ইত্যাদি ম্যাপ অনুযায়ী যেখানে নদী দেখানো আছে, সেখানে তো কোনো নদী এখন নেই। কাজেই সেই অনুযায়ী নদীটাকে কি এখানে পুনর্খনন করা হবে?”
এ নিয়ে নতুন করে ভাবা প্রয়োজন বলে মনে করেন সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের উপদেষ্টা ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আইনুন নিশাত।
তিনি বলেন, “আমাদের চিন্তার শুরু করতে হবে, নদী যেখানে শিফট করে গেছে, সেখানকার অবস্থাটার অ্যানালিসিস কী হবে?
“আদালত যে নিয়ম করেছেন, সেটা আমরা মানব। কিন্তু এটাকে প্র্যাকটিকাল করার জন্য বোধহয় একটু ভাবা দরকার আছে; যেখানে গত ৩০, ৪০, ৫০ বছরে নদী শিফট করেছে, সেখানে কী হবে?”