40 C
ঢাকা, বাংলাদেশ
বিকাল ৪:৫২ | ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ খ্রিস্টাব্দ | ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বঙ্গাব্দ
গ্রীন পেইজ
ডিডিটি (DDT) কি? ইহার উপকারিতা ও অপকারিতা গুলো কি কি? এবং কেন ইহার ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ?
পরিবেশ গবেষণা রহমান মাহফুজ

ডিডিটি (DDT) কি এবং কেন এর ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে?

ডিডিটি (DDT) কি? ইহার উপকারিতা ও অপকারিতা গুলো কি কি? এবং  কেন ইহার ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে?

রহমান মাহফুজ, প্রকৌশলী, পরিবেশ কর্মী, পরিবেশ এবং পরিবেশ অর্থনৈতিক কলামিষ্ট, সংগঠক এবং সমাজসেবী।

ডিডিটি হলো একটি কীটনাশক।

ডিডিটি’র পূর্ণ নাম ডাইক্লোরোডাইফিনালট্রাইক্লোরোমিথেন (Dichlorodiphenyltrichloroethane – DDT) । ইহার রাসায়নিক সংকেত নীচে দেওয়া হলো।

ইহা একটি বর্ণহীন, স্বাধহীন প্রায় গন্ধহীন রাসায়নিক কঠিন যৌগ। পরিবেশের জন্য ইহা কুখ্যাত হিসাবে ব্যপকভাবে পরিচিত।

ডিডিটি ১৮৭৪ সালে অস্ট্রেলীয় রসায়ণবিদ ওথমার জিডলার প্রস্তুত করেন। ১৯৩৯ সালে সুইস বিজ্ঞানী ড. পউলি হারমার মুলার ডিডিটির কীটনাশকের ক্ষমতা আবিস্কার করেন।

যে সকল কীট পতঙ্গ মানুষের রোগ জীবানু বহন করে অর্থাৎ কামড়ে মানবদেহে রোগ সৃষ্টি হয় উহাদের দমনে প্রথম ইহা ব্যবহার করা হয়; যেমন ম্যালেরিয়া বাহিত মশা।

কীট পতঙ্গ দমনে ইহার কার্যকারিতা জানাজানি হওয়ার পর ২য় বিশ্ব যুদ্ধের দ্বিতীয়ার্ধে সৈণ্যরা টাইফয়েড সৃষ্টিকারী দেহের উকুন (body lice) দমনে ইহা ব্যবহার করে।

২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ডিডিটি বাড়িতে এবং কৃষিজমিতে কীটপতঙ্গ দমনে ব্যবহার করা শুরু হয় এবং কীটপতঙ্গ দমনে বিপুল সাফল্য অর্জণ করে। যে সকল কীট পতঙ্গ দমনে ইহার সাফল্য রয়েছে সেগুলো হলো শুয়োপোঁকা (Gypsymoth), আলুর পোঁকা (potato pests), ভূট্টার মাটির কীট (corn earth worm) ।

কৃষিতে এবং রোগ বহনকারী পোঁকা দমনে ইহার সাফল্য কীটনাশক হিসাবে ইহাকে ২০ শতকে ব্যপকভাবে পরিচিত এনে দেয়। ইহার আবিস্কারক ড. পউলি হারমার মুলার ১৯৪৮ সালে চিকিৎসা শাস্রে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিকাজে এবং বাড়ীঘরে পোঁকা বা কীট দমনে ব্যবহারের জন্য সর্বত্র ইহা বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয় এবং সরকার কর্তৃক ইহার ব্যবহার ও উৎপাদনে উৎসাহ প্রদান করা হয়। ইহাতে কৃষি উৎপাদনে সাড়া জাগানো সাফল্য আসে এবং উৎপাদন ৩০% বৃদ্ধি পায়।

১৯৪৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বিশ্বব্যাপি ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু হ্রাস করার জন্য ম্যালেরিয়ার জীবানু বহনকারী এনোফিলিস (Anopheles )মশা দমনে ডিডিটি ব্যবহারে কর্মসূচী নেয়া হয়।

সে কর্মসূচীতে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, পূর্বের সোভিয়েত ইউনিয়ন, তাইওয়ান, ক্যারিবিয় অঞ্চলের বেশীর ভাগ এলাকা, ভলকান অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকার কিছু অংশ, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আশ্চার্যজনকভাবে ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপ হ্রাস পায় এবং ভারত ও শীলংকায় ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর হার একেবারেই কমে যায়।

কিন্তু এর সফলতা দীর্ঘ কাল ধরে রাখা যায়নি।

১৯৫৭ সালে প্রকৃতি বিষয়ক জনপ্রিয় লেখক রাসেল কার্সন (Rachel Carson) এর বরাত দিয়ে নাসাউ, নিউইর্য়ক এ ডিডিটির ক্ষতিকরের উপর একটি রির্পোট “নিউইর্য়ক টাইমস” এ প্রকাশিত হয়। তখন “নিউইর্য়ক টাইমস” এর সম্পাদক উলিয়াম সোয়ান (William Shawn) রাসেল কার্সনকে এই বিষয়ের উপর বিস্তারিত লেখার অনুরোধ করেন।

১৯৬২ সালে রাসেল কার্সন এর দুণিয়া জুড়ে সাড়া জাগানো বই (World ice Braking Book) ”Silent Spring” প্রকাশিত হয়। এ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর ডিডিটি বিষয়ে সারা বিশ্বে হৈচৈ পড়ে যায়।

বইটি তখন সর্বাপেক্ষায় বিক্রির তালিকার শীর্ষে উঠে আসে (Best Seller) এবং পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের নতুন গতি সৃষ্টি করে। বইটিতে ডিডিটিসহ কীটনাশকসমূহের বিষাক্ততা জীবজন্তু ও পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা তুলে ধরা হয় এবং এ ক্ষতিকর কীটনাশকসমূহের নিয়ন্ত্রনের অনুরোধ জনোনো হয়।

১৯৬৩ সালের যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি Silent Spring এ উথ্লাপিত বিষয়সমূহ যাচাই বাঁচাই করার জন্য তাঁর বিজ্ঞান উপদেষ্টাদেরকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন।

কমিটির রির্পোট Science জার্নালে প্রকাশিত হয় এবং রির্পোটে ধাপে ধাপে বিষাক্ত কীটনাশকসমূহ (persistent toxic pesticides) অপসারনের সুপারিশ করা হয়।

১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সরবরাহ হতে ডিডিটি বাদ দেয়া হয় এবং তার পরিবর্তে লিন্ডেন (lindane) সরবরাহ করা হয়।

১৯৬৭ সালে রাসায়নিক এবং কীটনাশক বিরোধীরা ডিডিটির বিরূদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং কিছু বিজ্ঞানী ও আইনজীবিসহ Environmental Defense Fund (EDF) গঠন করেন। এ সময়ে ভিক্টর ইয়ানাকোন, চার্লস ওয়ারস্টার, আর্ট কুলি এবং অন্যান্যরা পাখি নিধন বা পাখির জনসংখ্যায় হ্রাস প্রত্যক্ষ করেন এবং সন্দেহ করেন যে, এর কারণ ডিডিটিই।

প্রায় এই সময়ে, বিষতত্ত্ববিদ ডেভিড পিকাল প্যারাগ্রিন ফ্যালকন এবং ক্যালিফোর্নিয়া কনডোর পাখির ডিমে ডিডিটিরে উচ্চমাত্রা লক্ষ্য করেন এবং যার কারণে ডিমগুলোর পাতলা চামড়া হয়েছে বলে ধারনা করেন।

১৯৭১ সালে EDF ডিডিটি এর রেজিষ্ট্রেশন তালিকাচ্যুতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ডিষ্ট্রিক্ট আদালতে মামলা করে।

১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত ডিডিটির ব্যাপক ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞার রায় প্রদান করে।

১৯৭০- ১০৯৮০ সালের মধ্যে বেশীরভাগ উন্নত দেশ কৃষিতে ডিডিটির ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। ১৯৬৮ সালে হাঙ্গেরী, ১৯৭০ সালে নরওয়ে এবং সুইডেন, ১৯৭২ সালে পশ্চিম জার্মানী এবং মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র কৃষিতে ডিডিটির ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষনা করে, কিন্তু যুক্তরাজ্যের ইহা নিষিদ্ধ করতে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যায়।

১৯৯১ সালের মধ্যে নূ্ন্যতম ২৬ টি দেশ রোগ বাহিত কীট দমনসহ সম্পূর্ণভাবে ডিডিটির ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে; যেমন, কিউবা ১৯৭০ সালে, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৮০ সালে, সিঙ্গাপুর ১৯৮৪ সালে, চিলি ১৯৮৫ সালে এবং দক্ষিণ কোরিয়া ১৯৮৬ সালে সম্পূর্ণভাবে ডিডিটি ণিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জেনেভায় বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা ১২ টি ক্ষতিকারক পরিবেশ দুষণকারী যৌগ নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য মিলিত হয়। তারা মারাত্বকভাবে ক্ষতিকারক ৪ টি যৌগিকের যেমন. ক্লোরোডেন, ডাইলড্রিণ হেপাটেকক্লোর মিরেক্স এর ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

তারা একমত হন যে, ধাপে ধাপে এন্ডরিন, এবং টক্সাফেন জাতীয় জনস্বাস্থ্যের ক্ষতিকর যৌগ গুলো নিষিদ্ধ করা হবে।

২০০১ সালে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক জৈব দূষণকারী কীটনাশক (persistent organic pollutants- POPs) এর উপর স্টকহোম সম্মেলণ অনুষ্ঠিত (Stockholm Convention on Persistent Organic Pollutants) হয়।

ঐ সম্মেলনে ডিডিটিসহ ক্ষতিকারক জৈব দূষণকারী কীটনাশক উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ বা সীমিত করণের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় এবং এতদবিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৭১ টি দেশ উক্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং ২০০৪ সাল হতে তা কার্যকর হয়।

বিশ্বব্যাপি নিষিদ্ধ করা হলেও ভারতীয় উপমহাদেশ, উত্তর কোরিয়ার মত উন্নয়নশীল ও দরিদ্রদেশগুলোর কৃষিতে ও ম্যালেরিয়া দমনে ডিডিটি এখনও ব্যবহার হচ্ছে। ২০১৩ সালে ভারতে ২৭৮৬ টনসহ সারা বিশ্বে ৩০০০ টন হতে ৪০০০ টন ডিডিটি উৎপাদিত হয়েছে।

আমাদের দেশ বাংলাদেশেও ডিডিটির ব্যবহার থেমে নাই। নিন্মে ডিডিটির আরও কিছু ক্ষতিকারক দিক তুলে ধরা হ’ল: –

  • ডিডিটির অবশেষ (Residues) কয়েক মাস হতে কয়েক বছর পর্যন্ত থাকে। ত্বকের ফেটি টিসু এর মাধ্যমে ইহা জীবদেহের শোষিত হয় এবং জীবদেহের ফুড চেইন (food chain) এর মাধ্যমে পাকস্থলীতে পৌঁছে যায়।
  • অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে বহু বছর পরেও পরিবেশে ক্লোরেনেটেড হাইড্রো কার্বনের অবশেষ (residue) পাওয়া গিয়েছে এবং ইহা জীবদেহের এন্ডে্াক্রাইন সিসটেম (endocrine system) এর কাজে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং প্রানীর জন্মদান ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
  • কিছু বিজ্ঞানী বলেছেন যে, ইহা মানবদেহের জনন অঙ্গগুলো অকেজো করে দেয়, ফলে পুরুষের জনন অংগের পুংজনন কোষের উৎপাদন কমে যায় এবং সন্তান জন্মদান ক্ষমতার হ্রাস ঘটে। ইহার কারনে ব্রেস্ট ক্যানসার ও প্রোস্টেট ক্যানসার হয় (breast and prostate cancers) ।
  • ডিডিটিসহ সকল কীটনাশকই শুধু ক্ষতিকর পোঁকা ধ্বংস করে না, অনেক উপকারী পোঁকা এবং বিশেষ করে মাছ ও পাখির বংশ নির্মূলের জন্য দায়ী।

আমাদের দেশেও ডিডিটির মত ক্ষতিকারক বিষাক্ত কীটনাশক জরুরীভাবে বন্ধ করা উচিৎ।

Reference:

  1. Book: Environmental Toxicology (Second Edition) -By Ming-Hu Yu
  2. WIKIPEDIA
“Green Page” কে সহযোগিতার আহ্বান

সম্পর্কিত পোস্ট

Green Page | Only One Environment News Portal in Bangladesh
Bangladeshi News, International News, Environmental News, Bangla News, Latest News, Special News, Sports News, All Bangladesh Local News and Every Situation of the world are available in this Bangla News Website.

এই ওয়েবসাইটটি আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করে। আমরা ধরে নিচ্ছি যে আপনি এটির সাথে ঠিক আছেন, তবে আপনি ইচ্ছা করলেই স্কিপ করতে পারেন। গ্রহন বিস্তারিত