এক নজরে বিশ্বজুড়ে গত সপ্তাহের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ১ম পর্ব
–রহমান মাহফুজ ও আশফাকুর রহমান নিলয়
চীনে নতুন সংক্রমন কমে গেলেও ইতালিতে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব ও স্কুল বন্ধ হওয়ার ফলে নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে এবং উদ্বেগ ও নিজেকে বিচ্ছিন্নভাবে রেখে কিভাবে লড়াই করতে হয় তা শিখিয়ে দিচ্ছে। মহামারী করোনাভাইরাসের প্রভাবে সারাবিশ্বের অবস্থা নিয়ে সর্বশেষ সপ্তাহের অগ্রগতির কিছু দিক নিয়ে আলোকপাত করা হলোঃ
বিশ্বজুড়ে দেশসমূহ হাসপাতালে রোগীদের সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনার জন্য তাদের জনগণের চলাচলের উপর কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মন্ত্রীরা ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। ইতোমধ্যে ঔষধ ও ভ্যাকসিনগুলিকে ব্যবহার করার জন্য নানা ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।
বাল্টিমোরের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যানুসারে, গত বৃহস্পতিবার মহামারীটি মিলিয়নের এক-চতুর্থাংশের কাছাকাছি ছাড়িয়ে গেছে। তাদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ হচ্ছে চীন, ইতালি, ইরান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও স্পেন। সংক্রমনের আসল সংখ্যা আরও বেশী, কারণ অনেক দেশই তাদের লোকজনের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা তাড়াতাড়ি চালাতে পারছে না।
চীনের বড় আকারের লকডাউন ও অন্যান্য পদক্ষেপ নতুন আক্রান্তের সংখ্যাকে বাধাগ্রস্থ করেছে, কিন্তু ইতালি খুব খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। সেখানে মোট মৃতের সংখ্যা ৫,৪৭৬ ছাড়িয়েছে, যা কিনা চীনের মৃতের সংখ্যারও বেশী। ইতালিতে রোগটির প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল সমৃদ্ধশালী উত্তর থেকে, যা কিনা দক্ষিণে প্রভাবিত হয়েছে এবং ডাক্তাররা তাদেরকে “সুনামির” সাথে তুলনা করে ফেলেছেন।
এক সপ্তাহ আগে, WHO এর মহাপরিচালক ড. টেডরোস আদহানোম ঘেব্রেসাস বলেছেন,এখন করোনাভাইরাস মহামারীাটর “উপকেন্দ্র” হচ্ছে ইউরোপ। কিন্তু Sub-Saharan Africa হতে এই ভাইরাসে প্রথম মৃত্যু সংবাদটি এসেছিল বুরকিনা ফাসোতে, তিনি একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মহিলা ছিলেন। তিনি মহাবিশ্বের সবাইকে খারাপ সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন।
ইডেন বার্গ মেডিক্যাল স্কুল (Edinburgh Medical School) এর বিশ্ব জনস্বাস্থ্য ডিপার্টমেন্ট এর প্রফেসর দেবী শ্রী ধর লিখেছেন, ইউরোপের ভুলটি পুনরাবৃত্তি করতে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি আরও লিখেছেন, “ইউরোপ হয়ত ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধের সুযোগের পথটি হারাতে পারে, তবে আফ্রিকান দেশগুলির মধ্যে এখনও সুযোগ রয়েছে”।
বিশ্বব্যাপী এই মহামারীটির প্রভাব ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও পড়েছে। ইউরো ২০২০ ও আফ্রিকান নেশন্স চ্যাম্পিয়নশিপ ইতোমধ্যে স্থগিত করা হয়েছে, এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত সব ইংলিশ ফুটবল খেলা স্থগিত করা হয়েছে । বাংলাদেশেও ইতোমধ্যে সব ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক খেলা বন্ধ করে দিয়েছে। যদিও টোকিও অলিম্পিকের মশাল এখনও মানুষের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য এখনও উত্তাপ চড়াচ্ছে।
মিউজিক বিশ্বেও একই অবস্থা, যারা টেইলর সুইফট অথবা পল ম্যাকার্টনিকে দেখার অপেক্ষায় ছিলেন, তাদের আশাও গুঁড়েবালি। উৎসবটি স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যে ক্যান্টারবুরি এর আর্চবিশফ জাস্টিন ওয়েলকি এই ভাইরাসকে পারমাণবিক বিস্ফোরণের সাথে তুলনা করেছেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বোরিস জনসন. ব্রিটিশদের মধ্যে এই রোগের বিস্তারকে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে শান্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই সপ্তাহে তার যাত্রা শুরু করেছেন।
Covid-19 থেকে বেঁচে আসা লোকেরা পুনরায় সংক্রমণের হাত থেকে কীভাবে রক্ষা পাবে ও কতটা সময় প্রতিরোধ ক্ষমতাটি কাজ করবে সেটি সম্পর্কে এখনো কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
মানুষদেরকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য অভ্যাস গড়ে তোলা, কোথাও অযথা ভ্রমণ পরিত্যাগ করা এবং পাঁব, ক্লাব, থিয়েটার, রেঁস্তোরা ও অন্যান্য এরূপ স্থান থেকে দূরে থাকার জন্য বলা হয়েছে। ইম্পেরিয়াল কলেজ অব ইংল্যান্ড এর মডেল অনুসারে, এই পদক্ষেপটি মৃত্যুর সংখ্যা ২,৬০,০০০ থেকে ২০,০০০ এ কমিয়ে আনবে।
নতুন নিষেধাজ্ঞার কারনে যে সকল কর্মী দলে দলে বাসায় যাচ্ছে এবং স্কুল বন্ধের ঘোষণায় তারা তাদের সন্তানদের সাথে মিলিত হতে পারবে, তবে তাদের পরস্পরের মধ্যে নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ত বঝায় রাখতে হবে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালযের অধ্যাপক ডিযারডে হোলিংসওয়ার্থ সামাজিক দূরত্ব কীভাবে কাজ করে তা বর্ণনা করতে গিয়ে সায়েন্স সাপ্তাহিক পডকাস্টে যোগ দিয়েছিলেন, উদ্বেগ ও হতাশার অনুভূতিগুলির সাথে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে সে সম্পর্কে মনোবিজ্ঞানী জো হেমিংস এর সাথে কথা বলেছেন।
ইতোমধ্যে বিশ্বের সব ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিশ্বের বেশির ভাগ স্টক মার্কেট বন্ধ হয়ে গিয়েছে, যে গুলো চালু আছে সেগুলিতে মন্দা দেখা দিয়েছে। সোমবারে, দি ডো জোনস্ (the Dow Jones) ৩০০০ পয়েন্টের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, যা কিনা একদিনে সবচেয়ে বড় ধ্বস এবং ১৯৮৭ এর the Black Monday ধ্বসের পর এটি সবচেয়ে বড় শতাংশে ধ্বস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য রাষ্ট্রগুল এই মন্দা কাটানোর জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্যাকেজ বাস্তবায়নের বিষয়ে কথা বলেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২ জন রিপাবলিকান সিনেটরস্, সিনেট ইনটেলিজ্যান্ট কমিটির চেয়ারম্যান রিচার্ড বুর ও ক্যালি নয়েফলার, যার স্বামী নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেন্জেরে চেয়ারম্যান, বাজারে ধ্বসের পূর্বে লক্ষ লক্ষ ডলার মূল্যের শেয়ার বরাদ্দ করার পরে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে, ক্যালিফোর্নিয়াতে জরুরী ব্যতীত সকল ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে, ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ এবং ট্রাম্প প্রশাসন দেশকে বেকারত্বের তথ্যাদি প্রকাশে দেরী করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। অন্যান্য দেশে যেমনটা হয়েছে, অনেক হাসপাতাল কর্মীকে দরকারী জিনিসপত্র যেমন মাস্ক ও চশমা ছাড়া দেখা গেছে।
অস্ট্রেলিয়াতে জনগণকে অভ্যন্তরীণ ভ্রমণে সতর্ক করা হয়েছে এবং স্কুলের বন্ধের দিনের আয়োজনসমূহকে স্থগিতের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। দেশের বহিরাগতদের আগমন রোধে বর্ডার বন্ধ রাখা হয়েছে। হাজার হাজার বিদেশী জাহাজ, শহর ও এয়ারপোর্টে আটকা পড়েছেন এবং ভ্রমণে নিষেধ করা হয়েছে যাতে ভাইরাসটি না ছড়ায়।
শুক্রবার সিডনিতে ২,৫০০ যাত্রী যারা কিনা “ রাবি প্রিন্সেস (Ruby Princess)” জাহাজ থেকে নেমেছেন, তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৩ জনের মধ্যে ভাইরাস টেস্টে পজিটিভ ধরা পড়েছে।
আকাশ ভ্রমন বন্ধ হওয়ায় সারা পৃথিবী জুড়ে বিমান সংস্থাগুলোর লক্ষ লক্ষ কর্মী বেকার হয়ে পড়েছে। এযার নিউজিল্যান্ড তাদের কর্মীদের মুক্ত করে দিয়েছে, অষ্টেলিয়ার বিমান সংস্থা কোয়ান্টাস এর প্রধান নির্বাহী তাদের ২০,০০০ কর্মীকে কমনওয়েল্থ ব্যাংকের কল সেন্টারে অথবা উলউথস অন লাইন সোপ সেন্টারে চাকুরী দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।
করোনা ভাইরাস সংক্রামন ঠেকাতে দেশে দেশে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য সকল ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহ সীমিত করা হয়েছে, কোন কোন দেশ শহরাঞ্চলে কারফিউ জারী করেছে এবং সমস্ত দেশেই বন্ধ ঘোষনাসহ পুরো বিশ্ব হতে নিদিষ্ট সময়ের জন্য সেচ্ছায় বিছিন্ন হয়ে পড়েছে।
ইতোমধ্যে বিশ্বের সকল পর্যটন ও ভ্রমন কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তারকা হোটেলগুলো জনশূণ্য হয়ে পড়েছে। হোটল, মোটেল, রেস্তোরাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। রাস্তায়ও তেমন মানুষ দেখা যায়না। এমন অবস্থায় যাদের জন্মদিন উপস্থিত তাদেরকে শুধু সামাজিক মাধ্যমে জন্মদিনের সুভেচ্ছা জানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে, কেহ কেহ জানালায় হাত নাড়িয়ে সুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে।
করোনা ভাইরাস এখন বিশ্বকে শাসন করছে, গবেষকেরাও এই ভাইরাস প্রতিরোধে এখনও তেমন কিছু জানতে পারছে না এবং তারা এন্টিভাইরাল ড্রাগ ও ভ্যাকসিন এর কার্যকারিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা অবিরামভাবে চালিয়ে যাচ্ছে । ভাইরাস দ্বারা অন্তসত্বা মায়েদের গর্ভাশয়ে বিদ্যমান বাচ্চা সংক্রামিত হয় কিনা বা মায়ের দুগ্ধের মাধ্যমে শিশুদের শরীরে সক্রামিত হয় কিনা – তা এখনও জানা যায়নি।
গত সপ্তাহে আমেরিকা যুক্তরাষ্টের সিয়াটল অধিবাসী একজন নাগরিকের দেহে প্রথমবারের মত যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ড্রাগ কোম্পাণী মেডোনার তৈরী একটি করোনাভাইরাসের প্রতিষোধক ভাইরাল ভ্যাসকিন প্রয়োগ করা হয়েছে। একইভাবে যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা মানুষের নিরাপত্তার পরিক্ষা হিসাবে এপ্রিল মাসে এ ধরনের একটি অক্সফোর্ড ভ্যাসকিন প্রাণীর শরীরে প্রয়োগের প্রস্তুতি গ্রহন করছে।
কিন্ত এটার অর্থ এই নয় যে, বিশ্বের ভাইরাস বিশেষজ্ঞ, ইমিনিও বিশেষজ্ঞ, সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ এবং মেডিসিন বিশেষজ্ঞগণ এবং এসব বিষয় সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীগণ চাকুরীর অতিরিক্ত সময়ের কাজ করছে, আসলে তারা এ বিশ্ববাসীকে রক্ষায় সার্বক্ষনিকভাবে আপ্রাণ চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আমাদের ধনীরা তার নিজের ও বিশ্ববাসীকে করোনার মৃত্যু ছোবল হতে রক্ষায় এ ধরনের গবেষনার এবং ঔষধ ও ভ্যাসকিন তৈরীর ব্যয় মিটানোর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে।
পরিশেষে পরবর্তী সপ্তাহ পর্যন্ত ভাল থাকুন এবং পরিবারের সদস্যগনসহ নিজে নিয়মিত হাত ধুতে থাকুন। যদি বাড়িতে থাকুন তবে ছেলে মেয়েদের সাথে ভাল সময় কাটান।
Source: The Guardian