সমগ্র প্রাণিজগৎকে বেঁচে থাকতে হলে একটি সার্কেলের প্রয়োজন। সেই সার্কেলটি হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। টিকে থাকার প্রয়োজনে জীববৈচিত্র্যের এক প্রজাতি অন্য প্রজাতির ওপর নির্ভরশীল। এ সার্কেলে মানুষ বেঁচে থাকতে খাদ্য ও ওষুধ যোগাড় করছে জীববৈচিত্র্য থেকে।
বিষুব অঞ্চলের কাছাকাছি কর্কটক্রান্তি এবং মকরক্রান্তির মাঝামাঝি এলাকা মেগাডাইভারস হিসেবে বিবেচিত। এখানেই সবচেয়ে বেশি জীববৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এমন অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান। কিন্তু আমরা জীববৈচিত্র্যের মূল্য উপলব্ধি করতে পারি না। বন্যপ্রাণী নিধন, পাখির মাংস খাওয়া কিংবা পোকামাকড় পিষে মারা- এসব আমাদের নিত্যদিনের রুটিন। যা চাইলেও এখন আমরা বর্জন করতে পারছি না। ফলে জীববৈচিত্র্য আমাদের কাছে তুচ্ছ একটি বিষয়।
আমাদের সমগ্র দেশ জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। এর মধ্যে সুন্দরবন, সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া, বিভিন্ন হাওর, পাহাড়ি এলাকায় জীববৈচিত্র্যে বেশি লক্ষ্য করা যায়।
পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের প্রায় ৪০ ভাগের সন্ধান সুন্দরবনে পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫০ প্রজাতির মাছ ছাড়াও রয়েছে হাঙর, কুমির, ডলফিন ও রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বিভিন্ন ধরনের দুষ্প্রাপ্য উদ্ভিদও রয়েছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনে মোট ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৮৭টি একবীজপত্রী, ২৩০টি দ্বিবীজপত্রী, ১৭টি ফার্ন জাতীয়, ১৩ প্রজাতির অর্কিড ও ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল। জীববৈচিত্র্যের রক্ষণাবেক্ষণে উদ্ভিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
বাংলাদেশ একটি জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ দেশ। গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল বিধায় শীতপ্রধান দেশের তুলনায় বাংলাদেশে বৃক্ষ প্রজাতি এবং প্রাণিকুলের বৈচিত্র্য বেশি লক্ষ্য করা যায়। এও সত্য যে, ছোট একটি দেশে অত্যাধিক জনসংখ্যার চাপে ইতোমধ্যে অনেক গাছপালা ও লতাগুল্ম এবং প্রাণিবৈচিত্র্য হারিয়ে গেছে অথবা বিলুপ্ত হওয়ার পথে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই।
গাছপালা ও জীবজন্তু সংরক্ষণের জন্য বনাঞ্চল এবং জলাশয় অপরিহার্য হলেও আমাদের দেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ খুব কম। দক্ষিণাঞ্চলে সুন্দরবন এবং পার্বত্য অঞ্চলের কিয়দংশ ব্যতিরেকে বনাঞ্চলের দর্শন মেলে না। একদিকে দরিদ্র মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য বনাঞ্চলসহ প্রাণিকুলের ওপর নির্ভরশীলতা, অন্যদিকে অবৈধ উপায়ে গাছপালা এবং বন্যপ্রাণী নিধন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পরিবেশকে বিনষ্ট করেছে।
প্রাণীজগতের কোনো প্রাণী পৃথিবীতে চিরকালের জন্য আসেনি। প্রাকৃতিকভাবেই বিবর্তনের একটি অন্যতম ধাপ হল প্রজাতির বিলুপ্তি। কেনো কেনিয়াতে সাদা গণ্ডার প্রজাতির শেষ কর্ণধারের মৃত্যুতে আমাদের চিন্তিত হওয়া উচিৎ- তা নিয়ে আলোচনা করব।
পৃথিবীর আদিকাল থেকে অসংখ্য প্রাণী প্রজাতি পৃথিবীতে বসবাস করে হারিয়েও গেছে কালের গহবরে। একটি প্রজাতির সামগ্রিক বিলুপ্ত হতে একটি নির্দিষ্ট সময় যাপন প্রয়োজন। একেকটি প্রজাতি পৃথিবীতে অন্ততঃ ৫ থেকে ১০ লক্ষ বছর টিকে থাকে। এই সময়েই এরা বিবর্তিত হয়ে নতুন প্রজাতির উন্মেষ ঘটায়। এভাবেই অতীত থেকে জীববৈচিত্র্য বিবর্তিত হয়ে টিকে থাকছে। কোন প্রজাতি হঠাৎ বিলুপ্ত হয়ে গেলে প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানে একটি বিশাল ফাঁকা স্থানের সৃষ্টি হয়। আর এই শূন্যস্থান পূরণ হতে লেগে যায় কয়েক লক্ষ বছর। আমাদের পৃথিবী ইতোমধ্যে পাঁচ বার বড় ধরনের জীবচিত্র্যের বিলুপ্তির মুখোমুখি হয়েছে। সেই যে ডাইনোসর সব উধাও হল- সেরকমই। কিন্তু আগের সব বারের চেয়ে বর্তমানের জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তির ধরন অনেকাংশেই ভিন্ন। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে নয়, বরং মানবসৃষ্ট কারণে জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। প্রজাতি ক্ষতিগ্রস্থ হবার হার এতটাই দ্রত যে, নতুন প্রজাতির উন্মেষের সময়টুকুও পাচ্ছেই না। ফলে প্রকৃতিতে শূন্যস্থান তৈরি হচ্ছে।
প্রাণীবৈচিত্র্যের সাথে জীবসম্পদ ও বাস্তুসংস্থানীয় সেবার নিবিড় সংযোগ রয়েছে। জীবসম্পদ শব্দটিই মূল কথা বলে দেয়। জীবজগতের বিভিন্ন প্রজাতি বিভিন্নভাবে মানবপ্রজাতির সম্পদ হয়ে উঠছে। খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ সবই আসছে জীবজগৎ থেকে। তবে বাস্তুসংস্থানীয় সেবা কথাটি একটু অপরিচিত মনে হতে পারে। প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের বিভিন্ন প্রজাতি নিজেদের টিকে থাকার জন্য যেসব জৈবিক কর্ম সম্পাদন করে, আর আমরা নিজেদের স্বার্থে সেগুলোর ফায়দা লুটি, সেগুলোই হচ্ছে বাস্তুসংস্থানীয় সেবা। গাছ নিজেদের প্রয়োজনেই অক্সিজেন প্রস্তুত করে। মাঝে আমরা অক্সিজেন গ্রহণ করছি। পতঙ্গ নিজের প্রয়োজনেই পরাগায়ন ঘটাচ্ছে। মাঝে আমরা হচ্ছি সুবিধাভোগী। এইভাবে জীব জগতের অন্যান্য প্রজাতি আমাদেরকে সেবা দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়াতে শুধুমাত্র একটি প্রাণী প্রজাতি ‘কোয়ালার’ কারণে ১৯৯৭ সালে প্রায় ৭৫০ লক্ষ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছে।
প্রতিটি মৃত্যু আমাদের মন খারাপের কারণ হওয়া উচিৎ। হোক সেটি সুদূর আফ্রিকায় কোনো অপরিচিত প্রাণীর মৃত্যু। মানুষ জীবজগতের অন্যতম এক প্রাণী হয়ে নিজেদের স্বার্থে অন্যান্য প্রাণীদের পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য সরিয়ে ফেলার অধিকার রাখে না।
সহজ ভাষায়, নতুন প্রজাতি উন্মেষের যথেষ্ট সময় যেনো পায় এবং বিবর্তন প্রক্রিয়া চলমান থাকে- সেই জন্য আমাদের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে। জীববৈচিত্র্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের উপকারে আসে। একটি স্থিতিশীল পরিবেশের সাথে মানবপ্রজাতির ভালো থাকাটা সরাসরি নির্ভর করে। লাভ ক্ষতির হিসাব কষে নয়, বরং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে নীতিগত ভাবে।